• ১৪ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ , ৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ , ১৮ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

ভালোবাসার তৈরি বিশাল একজোড়া পাখা পরীমণির

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত আগস্ট ১৩, ২০২১
ভালোবাসার তৈরি বিশাল একজোড়া পাখা পরীমণির

তসলিমা নাসরিন, সানজানা, দিপায়ন আর অন্যরা আপনারা যারা শিশুদের সাথে পরীমণির ছবিগুলি পোস্ট করেছেন আপনাদের সাথে আমি অনেক রাগ করলাম। শুক্রবার ছুটির দিন আপনারা আমার মন ভিজিয়ে দিয়েছেন, চোখ ভিজিয়ে দিয়েছেন- ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাক মুছতে লাগিয়েছেন।

এটা ঠিক না! আপনাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা! এই মেয়েটার এইরকম রূপটা আপনারা দেখিয়ে দিয়েছেন। আমার চশমায় কি যেন একটা সমস্যা হয়ে গেছে,ঝাপসা চোখে এখন আমি যেখানেই পরীমণি দেখি, ওঁর পেছনে বিশাল দুই ভালোবাসার পাখা দেখি- পরী।

আমার চেয়ে আমাদের অনেকের চেয়ে বড়- অনেক অনেক অনেক বড় একটা পরী দেখি কেবল।

আমার জীবনে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা আমি কোথায় পেয়েছি জানেন? বলেছি আমি অনেকবার। কাহারিয়া ঘোনা প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম আমি। ক্লাস থ্রি, ফোর আর ফাইভ এই তিন বছর পড়েছি আমি সেই স্কুলে। বাঁশের বেড়া আর পুরনো টিনের চাল দেওয়া ছোট একটা স্কুল ঘর।

সেটাও আবার হেলে পড়েছে একদিকে। বৃষ্টির সময় ভাঙা বেঞ্চগুলিতে আমরা কোথাও জায়গা খালি রেখে কোথাও গায়ে গা ঠেকিয়ে বসতাম- টিনের চালের ফুটো দিয়ে বৃষ্টি পড়তো। ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে যখন যাই, দেখি কিছু বন্ধু ঝরে পড়েছে, পড়া ছেড়ে দিয়েছে। ফোর থেকে ফাইভেও একইরকম আর ফাইভ থেকে সিক্সে উঠে যখন হাইস্কুলে গেছি- আমার বন্ধুদের বেশিরভাগই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।

ওরা মেধায় যোগ্যতায় বুদ্ধিমত্তায় কেউই আমার চেয়ে কম ছিল না। আমার সেইসব বন্ধুরা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে কেননা ওদের পিতামাতা দরিদ্র ছিল। বৈষম্য। শিশুদের সাথে যে এই বৈষম্যটা আমাদের সমাজে আছে, সেটা আমি আমার শৈশবেই শিখেছি- শিখেছি কেননা আমি আমার বন্ধুদেরকে বঞ্চনার শিকার হতে দেখেছি। এই অনুভূতি আপনারা অনেকেই অনুভব করতে পারবেন না। একটি শিশু দেখতে পাচ্ছে তার বন্ধুটি ঠিকমত খেতে পায় না, সুন্দর একটা কাপড় পরতে পায়না, রংপেন্সিল কিনতে পায় না। কেন? ওরা পিতামাতা দরিদ্র বা পিতামাতা নেই? পিতামাতা দরিদ্র হয়েছে তো আমার বন্ধুটির কি দোষ ছিল? সে কেন পড়তে পেলো না!

ক্লাস নাইনে উঠে আমি খেলাঘর করেছি। আমাদের নিজেদের আসর সংগঠিত করেছি। আমি সবসময়ই অলস ছিলাম, কিন্তু খেলাঘর করতে একটুও আলসেমি করিনি। চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে যোগাযোগ করেছি, ক্লাস টেনে পড়ার সময় জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছি। খেলাঘর কেন? শিশুদের জন্যে বৈষম্যমুক্ত সমাজ তৈরির সংগ্রামের কথা বলতো খেলাঘর। পরে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। কম্যুনিস্ট পার্টির মেম্বার হতে চেষ্টা করেছি। কেন? অন্তরে বৈষম্যবিরোধী চেতনা ছিল। বৈষম্যের অবসান চেয়েছি। বৈষম্য যে অন্যায়, এই শিক্ষা আমি অনেক বড় মূল্য দিয়ে শিখেছি। আমার বন্ধুরা ছিটকে পড়েছে স্কুল থেকে, তখন গিয়ে শিখেছি শিশুদের সাথে বৈষম্য ব্যাপারটা কত অন্যায়, কত নিষ্ঠুর।

আমি জিয়াউর রহমানকে দেখেছি। হায় তার সে কি নাটকীয় উপস্থিতি। আমাদের হাই স্কুলের মাঠে জনসভা করে খাল কাটতে গেল। পায়ে কাপড়ের জুতার মত জুতা, কিন্তু সেই জুতা চামড়ার তৈরি। চোখে সানগ্লাস, মাথায় টুপি। নায়ক আলমগীর আর সাথে কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে গেলেন তিনি খাল কাটতে। আমার বন্ধুরা গেছে দল বেঁধে। ইঁচড়ে পাকা আমি ভাবলেশহীন মুখে বলেছি, বৈষম্য দূর করার কথা কি তিনি বলেছেন? শিশুদের প্রতি বৈষম্য দূর করার কথা যে বলবে না তিনি খাল কাটুক না অন্যকিছু কাটুক তাতে আমার কি আসে যায়!

বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল। আওয়ামী লীগ করতো সিরিয়াস সব লোকেরা- সাহসী কত বীর মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযুদ্ধের কথায় কার না প্রাণে দোলা দেয়? বঙ্গবন্ধুর কথায় কোন বাঙালির হৃৎপিণ্ড নড়ে ওঠে না? কিন্তু ওরা কি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে? না ভাইয়া, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে কম্যুনিস্টরা। আমি কম্যুনিস্টদের পেছনে গিয়ে সারিবদ্ধ হই। আমি তখন ইলা মিত্রের কথা পড়েছি। আমাকে লোকে শেখাতে আসে, কম্যুনিস্টরা কখনো ক্ষমতায় যাবে না, কম্যুনিস্টরা এটা কম্যুনিস্টরা সেটা। সেই কৈশোরেই আমি বিনয়ের সাথে ওদের কথা শুনেছি। কখনো মুখ ফুটে, কখনো মনে মনে বলেছি, আমি তো লড়াই করতে নেমেছি। লড়াইয়ের ক্ষুদ্র পদাতিক সৈন্যটি হতে চাই। কেন? কেননা আমি তো বৈষম্যের আগুনে পুড়েছি, আমি তো এই সমাজ রাখব না, ভেঙে ফেলবো। ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে দিয়ে এই মন্দ সমাজের ধ্বংসস্তূপের উপর নাচতে চাই।

পরীমণির প্রসঙ্গে এইসব কথা কেন বলছি? পরীমণি কি বিপ্লবী? না, মোটেই বিপ্লবী নন তিনি। তাইলে? পরীমণির ছবি দেখলাম আজকে, তিনি শিশুদের নিয়ে একসাথে কেক কাটছেন, শিশুদের জড়িয়ে ধরে আদর করছেন। ফটো বড় করে দেখেছি। এটাতে কি ভণ্ডামি ছিল? মনে হয় না- পরীমণির চোখে অনাবিল আনন্দ। ওঁর চারপাশে ঘিরে থাকা শিশুদের মধ্যে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া সেইসব বন্ধুদের দেখতে পাই। পরীমণি বিপ্লবী নন, নিতান্ত ভালোবেসেই তিনি শিশুদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এইটাতেই পরীমণি আমার চোখে বড় হয়ে গেছেন। আরেকজন নারীর আমার মনে পড়েছে- নিল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা অপরূপ রূপসী সেই বিদেশিনীও আমাদের দেশের অনেক শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।

না, আমি কল্যাণপন্থী নই। আমি মনে করি না যে কল্যাণ করে শিশুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অবসান ঘটানো যাবে। কিন্তু সেইটা তো হচ্ছে মোট ও পথের পার্থক্য। কেউ যদি প্রকৃতই শিশুদেরকে ভালোবেসে বুকে টেনে নেয়, আমি তাঁকে অবশ্যই সম্মান করবো। কেননা সেইসব শিশুরা তো আমার সেইসব বন্ধুরা। না, রজানীতিবিদ জেনারেল এইরকম অনেক বদমায়েশ আছে যারা ভণ্ডামি করে শিশুদেরকে নিয়ে, নিজেদের আখের গোছায়। ওদের কথা আলাদা। এই মেয়েটি তো শিশুদেরকে আদর করছে নিতান্ত ভালোবেসে।

আমি তো জানি ঈশ্বর নেই। আমি শিখেছি যে মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়। সুত্র সিলেট টূডে আপনারা যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তারাও তো মানবেন যে,আপনাদের ঈশ্বরও নিজে পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষের পাশে দাঁড়ান না। তিনিও কোন না কোন একজন মানুষকেই পাঠান মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে। তিনি মুসা নামের একজন মানুষকেই পাঠিয়েছেন ইহুদি জাতিকে ফারাওদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্যে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে চান, করেন, কিন্তু মানুষকে অস্বীকার করলে তো অন্যায় হবে!

যে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ায়, বিশেষ করে আর্ট শিশুদের পাশে দাঁড়ায়, তাঁকে সম্মান না করে পারবেন?

ছবিগুলি দেখেছি। নাহ, এই পুঁচকে মেয়েটাকে আর পুঁচকে লাগছে না। অনেক বড় লাগছে, অনেক অনেক অনেক বড়। আমার মাথা ছাড়িয়ে যেন আরও দেড় হাত উপরে ওঁর মাথা। ভালোবাসায় তৈরি বিশাল একজোড়া পাখা যেন এই পরীটির পেছনে, সেই পাখায় পরম আদরে সে আড়াল করে রেখেছে সেইসব শিশুকে। আহা, এইরকম প্রেমময় ছবি কেন অনেক অনেক দেখতে পাই না!

ইমতিয়াজ মাহমুদ: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
   
     

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/sylhetn4/public_html/wp-content/themes/shakil news/inc/post-query.php on line 110

Warning: Trying to access array offset on value of type bool in /home/sylhetn4/public_html/wp-content/themes/shakil news/inc/post-query.php on line 110