• ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

হবিগঞ্জের ইউনিয়ন অফিস যেন সৌদি দূতাবাস

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত আগস্ট ৭, ২০২২
হবিগঞ্জের ইউনিয়ন অফিস যেন সৌদি দূতাবাস

সৌদি আরবে যেতে হলে দূতাবাসে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিতে হবে। ছাপ দেওয়ার শেষ দিন গতকাল শনিবার (৬ আগস্ট)। দূতাবাসে নিতে গাড়িও পাঠানো হয় সবার বাড়ি। এরপর সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ২০ থেকে ২৫ জন নারী হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাউসা ইউনিয়ন পরিষদে আসেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেখানেই তাদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়।

এভাবেই অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সৌদি যেতে আগ্রহী নারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া একটি চক্রের তিন জনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার বিকালে বাউসা ইউনিয়ন পরিষদে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের ফাঁকে এমন প্রতারণা করতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের অপারেটরসহ তিন জনকে আটক করা হয়। জব্দ করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের আঙুলের ছাপ গ্রহণ পরবর্তী নতুন ভোটার হওয়ার ৬৫টি স্লিপসহ জাতীয় পরিচয়পত্র।

আটককৃতরা হলেন-নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কর্মসূচির কম্পিউটার অপারেটর বানিয়াচং উপজেলার জমশেদ মিয়া (৩০), সুনামগঞ্জ পৌরসভার ইকড়ছই গ্রামের আবু সুফিয়ান (৩৫) ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ফাহিম চৌধুরী (২৮)।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানান, গত ৪ আগস্ট থেকে নবীগঞ্জের বাউসা ইউনিয়নে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলছিল। শনিবার শেষ দিনে অন্যান্য দিনের মতো নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে ঠিকানা ও জন্ম নিবন্ধন নম্বরসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দেন ওই ইউনিয়নের নতুন ভোটাররা। এরপর দেন আঙুলের ছাপ।

এ সময় কম্পিউটার অপারেটর জমশেদ নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে ঠিকানা ও জন্ম নিবন্ধন নম্বরের তথ্য পূরণ না করেই সুনামগঞ্জের এক নারীকে বাউসা ইউনিয়নের ভোটার করার জন্য আঙুলের ছাপ নেন। এরপর নেত্রকোণার ফাহিমা ও বিশ্বনাথের রিমা বেগমের আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময় অপরিচিত দেখে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। এ সময় আবু সুফিয়ান, ফাহিম চৌধুরী ও তিন নারীকে আটক করা হয়। সেখান থেকে মোফাজ্জল নামে এক ব্যক্তি ২২ জন নারীসহ পালিয়ে যান। খবর পেয়ে নবীগঞ্জ থানার ওসি ডালিম আহমেদ, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানসহ একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে সন্ধ্যা ৭টার দিকে জমশেদ, আবু সুফিয়ান ও ফাহিমকে আটক করে থানায় নিয়ে যান।

সুনামগঞ্জের সুলতানা আক্তার সুমী বলেন, আমি তিন বছর সৌদি আরবে ছিলাম। এক বছর আগে দেশে এসেছি। আবার আমাকে সৌদি আরব পাঠানোর কথা বলে চলতি বছরের এপ্রিলে দালাল আবু সুফিয়ান ১৫ হাজার টাকাসহ পাসপোর্ট নেন। তিনি জানান, সৌদি যেতে হলে অ্যাম্বাসিতে আঙুলের ছাপ দিতে হবে। তাই তার সহযোগী মোফাজ্জল মিয়া ও ফাহিম চৌধুরীর মাধ্যমে সৌদি আরবে যেতে ইচ্ছুক আমিসহ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সিলেটের বিভিন্ন স্থান থেকে ২৫ জন নারীকে আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য সৌদি অ্যাম্বাসিতে নিতে দুটি মাইক্রোবাসে করে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমি আঙুলের চাপও দিয়েছি।

নেত্রকোণার ফাহিমা আক্তার বলেন, আমি চট্টগ্রামে একটি গামেন্টেসে চাকরি করি। সৌদি আরবে নেওয়ার নাম করে সুফিয়ান আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। শনিবার সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য আঙুলের চাপ দেওয়ার শেষদিন। এমন কথা বলে চট্টগ্রাম থেকে আমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। ঝামেলার জন্য আমি আঙুলের ছাপ দিইনি।

রিমা বেগম বলেন, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আমিসহ ২৫ জন নারী সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে কয়েক লাখ টাকা সুফিয়ান ও তার সহযোগী মোফাজ্জল মিয়া ও ফাহিম চৌধুরীর কাছে দিয়েছি। আঙুলের ছাপ দেওয়ার জন্য এখানে আসি। আমরা গ্রামের মানুষ আমরা তো আর বুঝিনি যে বিদেশের জন্য ছাপ দিতে এনে এখানে আমাদের নতুন ভোটার করাচ্ছে।

আজিজুর রহমান নামে স্থানীয় এক যুবক জানান, তিন দিন ধরে নতুন ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম চলছে। শনিবার শেষ দিনে অন্যান্য জেলার বাসিন্দাদের বাউসা ইউনিয়নের ভোটার করার জন্য নিয়ে আসা হলে প্রতারণার এক পর্যায়ে ধরা পড়ে।

বাউসা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদিকুর রহমান শিশু মিয়া বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে তথ্য গোপন করে বাউসা ইউনিয়নে ভোটার করার জন্য কয়েকজন দালাল ও নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আমার ইউনিয়নে নিয়ে আসা হয়। আঙুলের ছাপ দেওয়ার সময় গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় মানুষ অপরিচিত দেখে তাদেরকে আটক করে।

এ বিষয়ে নবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের ফাঁকে অন্য উপজেলার ভোটরদের বাউসা ইউনিয়নের ভোটার করা হচ্ছে এমন সংবাদে ঘটনাস্থলে এসে এর প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি। বাউসা কেন্দ্রের টিম লিডার মতিউর রহমান বাদী হয়ে আটককৃত দালাল চক্র ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। কেউ জড়িত থাকলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তিনি আরও বলেন, যারা ভোটার হয়েছেন তাদের তথ্য অফলাইনে রয়েছে। উদ্ধার হওয়া স্লিপের সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী তথ্য যাচাই-বাছাই করে এগুলো বাদ দেওয়া হবে। দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়ার সুযোগ নেই।

নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ডালিম আহমেদ জানান, সৌদি যাওয়ার জন্য অ্যাম্বাসিতে আঙুলের চাপ দেওয়ার নাম করে একটি চক্র বিভিন্ন জেলা থেকে নারীদের বাউসা ইউনিয়ন অফিসের চলমান নতুন ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমে নিয়ে আসে। এখানে নতুন ভোটার হওয়ার ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্য না দিয়েই তাদের আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। এ ঘটনায় কম্পিউটার অপারেটরসহ তিন প্রতারককে আটক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •