• ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

গোয়াইনঘাটে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মহসিন’র বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত মার্চ ২৬, ২০২৪
গোয়াইনঘাটে যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মহসিন’র বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক:: সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার এক সহকারি যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক অনিয়ম দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ভাতার টাকা আত্মসাৎ সহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সহকারি উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন, দীর্ঘ ২০ বছর ধরে গোয়াইনঘাট উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসে কর্মরত। দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থাকার সুবাদে বানিয়েছেন অর্থের পাহাড়। অফিসের একমাত্র সর্বেসর্বা তিনি। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলে অর্থের লোভ দেখিয়ে মীমাংসা করা যেনো তার চিরাচরিত এক অভ্যাস। এই কর্মকর্তা টানা ২০ বছর গোয়াইনঘাট উপজেলা যুব উন্নয়ন কার্যালয়ে খুঁটি গেড়ে বসেছেন। আর সেই খুঁটির জোরে একের পর এক করে যাচ্ছেন অনিয়ম ও দুর্নীতি। যুব উন্নয়ন অফিসের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসার বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন এনামুল হক নামের এক যুবক।

এনামুলের লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে যুব প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত প্রশিক্ষণার্থী ও প্রকল্পদ্বারিদের মাঝে যুব ঋণ প্রদান করা হয়। এতে এনামুল বিগত ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে ১টি যুব ঋণ গ্রহণ করেন এবং নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন। ঋণ পরিশোধ করার পর যুব উন্নয়ন অফিসের সহকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন তাকে বলেন, আপনার নামে ২য় বার ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ১টি ঋণ দেয়া হবে। এবং ঋণ অনুমোদন কমিটির স্বাক্ষরে এনামুলের নামে একটি ঋণ পাশও হয়। পরবর্তীতে এনামুল হক জানতে পারেন যে, তার নামে ঋণ পাশ করা হয়েছে, অথচ তাকে আর উক্ত ঋণ দেওয়া হয়নি। অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয় যে, একই ব্যক্তিকে একই নামে বার বার ঋণ প্রদান করা হয়। নজরুল ইসলাম নামের একজন সরকারি চাকুরিজীবীকে উদ্যোক্তা ঋণ প্রদান করা হয়েছে এক লক্ষ টাকা, ঋণ পরিশোধ করা হয় নাই এখন পর্যন্ত। আবার উপজেলা পর্যায়ে ঋণ দেওয়া হয়েছে নজরুল ইসলাম এর নামে ৫০ হাজার এবং তার স্ত্রীর নামে ৪০ হাজার টাকা। তারই আত্মীয় আরো ২/৩ জনকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এনামুল হক তার ঋণটি আজও পর্যন্ত পাননি।

সূত্র জানায়, নিজের পছন্দমত লোক ব্যতিত কাউকেই তিনি যুব ঋণ সহ কোনরকম সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন না। কিন্তু তার মনের মত একই ব্যক্তিকে বার বার সরকারি যুব ঋণ প্রদান সহ নানা সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছেন। নিয়ম অনুযায়ী যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় প্রশিক্ষিত বেকার যুবক/যুবতীদের ঋণ দেয়ার কথা, সেখানে তিনি কোনরকম নিয়ম না মেনে অনেক প্রশিক্ষিত বেকার যুবকদের বাদ দিয়ে নিজের পছন্দমত লোকদের সাময়িক প্রশিক্ষণ সনদ নিজে তৈরী করে দিয়ে ঋণ প্রদান করেন। অথচ উপজেলার অনেক প্রশিক্ষিত যুবকরা একাধিকবার আবেদন করেও ঋণ বঞ্চিত হচ্ছেন এবং সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সের কোন পুরুষ ও নারীকে ঋণ দেয়া যায় না, সেখানে তিনি ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সের একাধিক ব্যক্তিদেরও ঋণ প্রদান করার ও নজির রয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় বেকার যুবক যুবতীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজেক্টের ট্রেনিং করানো হয়, সেখানে তিনি ট্রেনিং না করিয়ে বাজেটের টাকা আত্মসাৎ করার ও অভিযোগ রয়েছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

সহকারি এই যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার একাধিক দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ প্রতিবেদকের হাতে আসলে সেই তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায়, বিগত ১০ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত হাঁস-মুরগি পালনের জন্য একটি প্রশিক্ষণ হয় উপজেলার পূর্ব র্জাফলং ইউনিয়নের চৈলাখেল ৯ম খন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, অফিসিয়াল কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে সেই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছেন মোট ৩০ জন যুবক যুবতী। এবং তাদেরকে দৈনিক ১০০ টাকা হারে ৬ দিনে মোট ৬০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হয়েছে। অথচ সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে সকল ব্যক্তিদের নাম ঠিকানা কাগজে কলমে দেখানো হয়েছে, বাস্তবে ওই এলাকায় এসব ব্যক্তিদের কোন অস্তিত্বই নেই। এবং ট্রেনিংপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামের সাথে অফিসিয়াল ভাবে সংরক্ষিত ফাইলে যেসব মোবাইল নাম্বার যুক্ত করা হয়েছে, ফোন করলে তাদের অধিকাংশ নাম্বারই বন্দ পাওয়া যায়। আর যেসব নাম্বারে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে তাদের বেশীরভাগই সিলেটের বাহিরের লোক। অর্থাৎ তালিকায় উল্লেখিত সকল মোবাইল নাম্বারই ভুল। তিনি তার মনগড়া প্রত্যেকের নামের পাশে একটি করে নাম্বার যুক্ত করে শুধুমাত্র কাগজে কলমে ট্রেনিং দেখিয়ে ভাতার টাকা উত্তোলন করে তিনি নিজেই আত্মসাৎ করেছেন।

একই ভাবে ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ৩ জানুয়ারি ২০২০ সাল পর্যন্ত উপজেলার লাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাঁস মুরগি পালনের আরেকটি ট্রেনিং দেখানো হয়েছে। সেখানেও অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে ৩০ জন প্রশিক্ষণার্থী। তাদেরও দৈনিক জনপ্রতি ১০০ টাকা হারে ৬ দিনের ৬০০ টাকা করে মোট ৩০ জনের টাকা তিনি নিজেই আত্মসাৎ করেছেন। এবং সেই তালিকায়ও তিনি সকল প্রশিক্ষণার্থীদের নাম ঠিকানা ও মোবাইল নাম্বার ভুল লিখে হাতিয়ে নিয়েছেন ভাতার টাকা। সরেজমিনে ট্রেনিং ও তালিকায় উল্লেখিত ব্যক্তিদের কোন অস্থিত্বই খোঁজে পাওয়া যায়নি।

উপজেলার লাখেরপার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১লা মার্চ ২০২০ থেকে ৭ই মার্চ ২০২০ সাল পর্যন্ত হাঁস-মুরগি পালনের আরেকটি ট্রেনিং দেখানো হয়েছে, সেখানেও ৩০ জন প্রশিক্ষণার্থীদের অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে। এবং দৈনিক ১০০ টাকা হারে জনপ্রতি ৬০০ টাকা করে ৩০ জন লোকের ভাতার টাকা উত্তোলন করে তিনি নিজে আত্মসাৎ করেছেন। সরেজমিনে এসব ট্রেনিং কিংবা তালিকায় উল্লেখিত প্রশিক্ষণার্থীদের কোন অস্তিত্ব খোঁজে পাওয়া যায়নি।

অনুরুপ ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ হতে ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২০ সাল পর্যন্ত উপজেলার মুসলিমনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬ দিনের একটি ট্রেনিং দেখানো হয়েছে। সেখানেও কাগজে কলমে অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে ৩০ জন, দৈনিক ১০০ টাকা হারে ৬ দিনে জনপ্রতি ৬০০ টাকা করে মোট ৩০ জনের ভাতার টাকা উত্তোলন করে তিনি নিজেই আত্মসাৎ করেছেন।

উপজেলার পুর্ব আলীরগাঁও ইউনিয়নের নয়াখেল আশ্রয়ন কেন্দ্রে হাঁস-মুরগি পালনের জন্য ৬ দিনের একটি ট্রেনিং দেখানো হয়েছে। সেখানেও কাগজে কলমে দেখানো হয়েছে মোট ২৫ জন যুবক-যুবতী সেই ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন। এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য দৈনিক ১০০ টাকা হারে ৬ দিনে মোট ৬০০ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হয়েছে। অথচ সরেজমিন অনুসন্ধানে প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে মাত্র একদিন ট্রেনিং করানো হয়েছে এবং তাদের কাউকেই কোন প্রকার ভাতা প্রদান করা হয়নি। অর্থাৎ এই যুব উন্নয়ন সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন এসব ব্যক্তিদের নামে ভাতার টাকা উত্তোলন করে তিনি নিজেই তার পকেটস্থ করেছেন। এছাড়া একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান, একজন ব্যক্তির কাছে পুরাতন ঋণ অপরিশোধিত থাকা সত্বেও পুনরায় ওই ব্যক্তিকে ঋণ প্রদানসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় ট্রেনিং প্রাপ্ত যুবক কামরুল ইসলাম বলেন, তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আওতায় বিগত ২০১৬ সালে মডার্ন অফিস মেনেজম্যান্ট এন্ড কম্পিউটার এ্যপ্লিকেশন কোর্সের উপর ট্রেনিং করেন। এবং তার প্রশিক্ষণের সনদপত্র ও রয়েছে। এমতাবস্থায় তিনি গোয়াইনঘাট উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসে একটি যুব ঋণের আবেদন করেন, কিন্তু সকল বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাকে ঋণ প্রদান করা হয়নি। অনেকের ট্রেনিংয়ের সনদপত্র নেই অথচ তাদেরকে সাময়িক সনদপত্র তিনি নিজেই তৈরী করে দিয়ে তাদের নামে ঋণ প্রদান করেন এবং সনদ ছাড়াও ইতিমধ্যে অনেককেই তিনি ঋণ প্রদান করেছেন। অনেক ব্যক্তি পুরনো ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও পুনরায় তাকে ঋণ দেয়া হয়েছে। অথচ বেকার অনেক যুবককে আবেদন করা সত্ত্বেও ঋণ দেওয়া হয়নি। অর্থাৎ এই যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার পছন্দমত ব্যক্তিদের শুধুমাত্র ঋণ প্রদান করে থাকেন অন্যথায় কাউকেই তিনি ঋণ প্রদান করেন না। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, একই পরিবারের স্বামীর নামে রয়েছে ঋণ আবার তার স্ত্রীর নামেও ঋণ রয়েছে। এরকম পরিবারের অনেক সদস্যদের তিনি ঋণ প্রদান করেছেন। যুব উন্নয়ন অফিসের সহকারি এই কর্মকর্তার এতসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও কর্তৃপক্ষ একেবারে নির্বিকার।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়াইনঘাট উপজেলা সহকারি যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিন তিনি তার নিজের বিরুদ্ধে আনিত কোন অভিযোগেরই সদুত্তর দিতে পারেন নি।

গোয়াইনঘাট উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ জহিরুল হক জানান, আমি গোয়াইনঘাটে এসেছি ২০২২ সালে, আর এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বেশীরভাগ অভিযোগই আমি এখানে যোগদানের পূর্বের। এ বিষয়ে আমি অবগত নয়, তবে যেহেতু বিষয়টি এখন জেনেছি, খোঁজখবর নিয়ে উত্তাপিত অভিযোগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হবে। আর এনামুল হক নামের যুবকের অভিযোগের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, সহকারি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসিনকে শোকাজ করা হবে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •