নিউজ ডেস্কঃ সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্ত চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। এ অঞ্চলে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাটাতারের বেড়া না থাকায় সীমান্ত পথে দিন-রাতে ভারত থেকে স্রোতের মতো আসছে গরুসহ চোরাইপণ্য। হরহামেশাই ঢুকছে মাদক, গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্রের চালান। পাচার হচ্ছে, মটরশুটি, মশুর ডাল, রসুন, স্বর্ণের বারসহ বিলুপ্ত প্রজাতির সুন্ধি কাছিম (কচ্ছপ)। আর এই চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। তারা বিজিবি, ডিবি ও থানা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে নিরাপদে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে জাতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্তে চোরাচালানে জড়িতদের তালিকা করেছে। এই তালিকায় ৮৬ জনের নাম থাকলেও মোস্ট ওয়ানটেড হিসেবে ২১ জন চোরাকারবারীকে চিহ্নিত করা হয়। তালিকায় বিজিবি-ডিবি, থানা পুলিশের নিয়োজিত সোর্স-লাইনম্যান, সাবেক-বর্তমান জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের নামও আছে। তালিকাটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে।
জানা যায়, গেল বছরে জৈন্তাপুরের হরিপুর বাজারে র্যাব-৯ এর একটি দল চোরাচালন পণ্য ধরতে গিয়ে হামলার শিকার হয়। এসময় চোরাকারবারীদের হামলায় বেশ কয়েকজন র্যাব সদস্যও আহত হয়েছিলেন। এরপর ওইদিন রাতে চোরাকারবারীদের আটক ও চোরাইমাল উদ্ধার করতে বিশেষ অভিযান চালায় র্যাব। অভিযানে আটক করা হয় ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান (তৎকালিন) আব্দুল কাহির পঁচা, ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারীসহ প্রায় ৩০ জনকে আটক করে। মূলতঃ এ ঘটনার পর গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নামে দীর্ঘ তদন্তে উঠে আসে চোরাকারবারীদের নাম ঠিকানা। এই চোরাকারবারীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করা হবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় যাদের নাম : জৈন্তাপুরের কেন্দ্রী গ্রামের আহমদ আলীর ছেলে রুবেল আহমদ (বিজিবি’র সোর্স), একই গ্রামের তেরা মিয়ার ছেলে আহমদ আলী, আসামপাড়ার সৈয়দ আলীর ছেলে রাশিদ আলী, মাস্তিংহাটি’র আলতাফ মিয়ার ছেলে ইসলাম উদ্দিন, কদমখালের কালা মিয়ার ছেলে জসিম উদ্দিন, আলু বাগানের টেম্বল মিয়ার ছেলে রুবেল মিয়া, একই গ্রামের সৈয়দ জহিরের ছেলে সৈয়দ মাসুম, গৌরী শংকর এলাকার তফন মিয়ার আব্দুল্লাহ, গোয়াইঘাটের পাঁচ সেউতি গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে সুহেল আহমদ, কালিঞ্জিবাড়ী’র মালিক, আলু বাগানের (মোকামবাড়ি) আং লতিফের ছেলে সৈয়দ রাজু, একই এলাকার সৈয়দ মিজান, আলু বাগানের ছন্দাই মেম্বারের বাড়ি’র লোকমান হোসেন চৌধুরী, হেমু গ্রামের আব্দুর রফিকের ছেলে হাজী মোহাম্মদ আলী ও তার ভাই হোসেন আলী, বালিপাড়া’র সমছুল আলীর ছেলে নুরুল ইসলাম, কানাইঘাট দূর্গাপুরের ইলিয়াছ আলীর ছেলে আলকাছ মিয়া, জৈন্তাপুরের কান্দিগ্রামের মতছির আলীর ছেলে রিয়াজ আহমদ, বালিপাড়ার নয়াখেল গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে শাহজাহান, একই এলাকার সফর আলীর ছেলে আলমগীর, কানাইঘাটের বড়বন্দ ১ম খন্ডের ইলিয়াস আলীর ছেলে শাহজাহান, বড়বন্দ ৪র্থ খন্ডের আশিক, একই কানাইঘাটের সিঙ্গারীপাড়ার আব্দুল হাসিমের ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য নুর আহমদ, কান্দিগ্রামের রকিব আলী ছেলে আব্দুল হাই, জৈন্তাপুরের ডিবির হাওর এলাকার মৃত মস্তকিনের ছেলে হারুন মিয়া, সুলেমান আহমদ (মৃত), আব্দুল হান্নান পটল, গৌরীশংকর গ্রামের প্রকাশ হাওলাদারের ছেলে নাজমুল ইসলাম মুন্নি, নিজপাটা ইউনিয়নের ফুলবাড়ি ঘিলাতৈলের মৃত হাছন আলীর ছেলে মনসুর আহমদ, তার ভাই মনা আহমদ, একই এলাকার সামছুল ইসলাম, নিজপাটা তেয়াসীহাটি’র আরিফ আহমদ, মাজিহাটি’র সিদ্দিক আহমদ, লামা শ্যামপুরের মুছা মিয়ার ছেলে জালাল উদ্দিন, নিশ্চিন্তপুরের নুর উদ্দিন মাষ্টারের ছেলে সেলিম আহমদ (বিজিবি’র সোর্স), লাল জৈন্তাপুরের মৃত আব্দুর রহিমের ছেলে মো. জালাল উদ্দিন, ফতেপুর ইউনিয়নের সাবেক বহিস্কৃত চেয়ারম্যান মো. রফিক আহমদ, হেমু ভাটিপাড়ার মো. ইয়াহইয়া, হেমু মাজরটুলের বিলাল, মানিকপাড়ার বিলাল আহমদ, ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি রফিক আহমদ, হেমু গ্রামের হেলাল আহমদ, হরিপুরের আব্দুল মালিক ওরফে মালিক হাজী’র ছেলে সুফিয়ার, হেলিরাই এলাকার আবুল হোসেন, কালিঞ্জিবাড়ী’র মো. রহিম উদ্দিন (বিজিবি’র সোর্স), ডিবি’র হাওর-এর ফরিদ আহমদ ও গফুর মিয়া, গৌরীশংকর গ্রামের লাল মিয়া ওরফে লালা ও তার ছেলে পারভেজ, জৈন্তাপুর উপজেলার পাখিবিল গ্রামের আলী আহমদ, আবুল খয়ের, টিপরাখলা গ্রামের শাহীন আহমদ ও আমিন, গৌরীশংকর এলাকার ডালিম, কেন্দ্রী গ্রামের মো. আজাদ মিয়া, ৪নং বাংলাবাজারের বারেক, কেন্দ্রী গ্রামের বেলু ও জিতু (হিন্দু পরিবার), আসামপাড়ার মতিন, বিলাল ও কাশেম, গুচ্ছগ্রামের এরশাদ ও দিলিপ, লামাশ্যামপুরের স্বপন মোল্লা ওরফে সোবহান মোল্লা।
এছাড়া মোস্ট ওয়ানটেড : ঘিলাতৈল গ্রামের আব্দুল করিম ওরফে ব্রান্ডিজ করিম, রুপক রায় ওরফে ঢাকাইয়া রুপক, হরিপুরের রফিক আহমদ উরফে লোদাই হাজী, আলু বাগানের কবিরাজ ফারুক, কেন্দ্রি গ্রামের মিজান আহমদ রুবেল, আনোয়ার হোসেন, রাম কিশ্বাস, শ্রমিকনেতা সাইফুল ইসলাম, আলী আকবর, হেলাল উদ্দিন, ইমরান হোসেন, সোহেল আহমদ, ইউনুছ মিয়া, গুলজার মিয়া, আব্দুল করিম, আব্দুল্লাহ মিয়া, লালা মিয়া, পারভেজ মিয়া, নজরুল ইসলাম নজাই, নাজিম মিয়াসহ আরো অনেকই চোরাচালানির সাথে জড়িত।
এসব চোরাকারবারীদের মাধ্যমে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টের নদী, পাহাড় দিয়ে নানা কৌশলে চোরাই পথে প্রবেশ করছে ভারতীয় নাছির বিড়ি, পাতার বিড়ি, টাটা গাড়ির পার্টস, টায়ার, মোটরসাইকেল, ভারতীয় বিড়ি, নিম্নমানের চা-পাতা, হললিক্স, ঔষধ, কসমেটিক্স, সুপারী, ইয়াবা ও বিভিন্ন ব্রান্ডের মদসহ ভারতীয় গরু বাংলাদেশে আসছে। আর বাংলাদেশ থেকে মটরশুটি, মশুর ডাল, রসুন, স্বর্ণের বার প্রভৃতির পাশাপাশি বিলুপ্ত প্রজাতির সুন্ধি কাছিম (কচ্ছপ) ভারতে পাচার হচ্ছে। এ তথ্য জানান সীমান্ত এলাকার একাধিক বাসিন্দা। তারা বলেন, দিনের বেলায় সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে, জঙ্গলে শত শত গরু বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকে।
সরেজমিন দেখা যায়, জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের সিঙ্গারীরপাড়, বালিদাঁড়া, ইয়াংরাজা, আফিফা-নগর চা বাগান, বাঘছড়া, তুমইর, জঙ্গীবিল, লালাখাল চা বাগান, লালাখাল গ্রান্ড ও নিজপাট ইউনিয়নের কালিঞ্জিবাড়ী, জালিয়াখলা, হর্নি, বাইরাখেল, লালাখাল রিসোর্স সেন্টার এলাকা, নয়াগ্রাম, মাঝরবিল, গোয়াবাড়ী, টিপরাখলা, ফুলবাড়ী, মহিষমারা, কমলাবাড়ী, ঘিলাতৈল, খলারবন্দ, আতাউরের বাগান, ডিবির হাওর, জৈন্তাপুর ইউনিয়নের কেন্দ্রী বিল, কেন্দ্রী হাওর, কাঁঠালবাড়ী, ঝিঙ্গাবাড়ী, মিনাটিলা, ছাগল খাউরী, আসামপাড়া, আদর্শগ্রাম, শ্রীপুর, মোকামপুঞ্জি, আলুবাগান, নলজুরীসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন চোরাচালান বাংলাদেশে ঢুকছে।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন