• ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৫ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কেন ভোটদানে বিরত বাংলাদেশ

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত জুন ২১, ২০২১
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কেন ভোটদানে বিরত বাংলাদেশ

মিয়ানমারের সঙ্গে সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক নেই বাংলাদেশের। জোরপূর্বক বিতাড়িত মিলিয়নাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালালেও দেশটি এখনও এটাকে প্রত্যাশিতভাবে সাড়া দেয়নি। তবু জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত এক প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থেকেছে। এনিয়ে আলোচনার সময়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের অবস্থান।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করা সামরিক জান্তাকে নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ শুক্রবার ওই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। মিয়ানমারের কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই প্রস্তাব পাস হয়। ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়ে ১১৯টি, বিপক্ষে একটি। ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ, রাশিয়া, চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান, লাওস, থাইল্যান্ডসহ ৩৬টি দেশ।

আইনগতভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়া প্রস্তাব মানা বাধ্যতামূলক না হলেও, রাজনৈতিকভাবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাবে কেন ভোটদানে বিরত ছিল বাংলাদেশ বিষয়টি শনিবার বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ওই প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোন উল্লেখ না থাকায় বাংলাদেশে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে, তা বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে দ্রুত রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় নিরাপদে এবং স্থায়ীভাবে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ তৈরির কোন প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়নি। সেখানে রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, তেমনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কোন সুপারিশ বা পদক্ষেপ নেই। প্রতিবেশী দেশ এবং মিয়ানমারের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও এসব মৌলিক গুরুত্বের বিষয়গুলো এই প্রস্তাবে না আসায় বাংলাদেশ ওই প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থেকেছে।

বাংলাদেশে বলেছে, গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে মিয়ানমারে সংবিধান পুনর্বহালের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার বিষয়ে যেকোনো প্রস্তাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি সেটায় রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ উল্লেখ করা না হয়। ২০১৭ সালের সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞের পরেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই বিষয়টি উল্লেখ করতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারকে যেমন একপ্রকার দায়মুক্তি দিচ্ছে, তেমনি দেশটির অন্য সংখ্যালঘুরাও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ বলেছে, যদিও অনেক দেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সহায়তা কোন সমাধান নয়। এ জন্য রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন এবং সেটা অবশ্যই মিয়ানমারে হতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফেরত পাঠাতে যেসব শর্ত পূরণ হওয়া দরকার, তার কোন অগ্রগতি নেই।

আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডাসহ জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোর একটি কোর গ্রুপ প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করেছে, যেখানে মিয়ানমারের সামরিক নেতারাও অংশ নিয়েছিলেন। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের ওই সম্মেলনে যে পাঁচ দফা কার্যকরের আহ্বান জানানো হয়েছিল, সেটাই এসেছে জাতিসংঘের এই প্রস্তাবে। কিন্তু সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় মিয়ানমারের অভ্যুত্থানে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রত্যাবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এখন পর্যন্ত সেটা আসেনি, যা একটি ভুল বার্তা দিতে পারে বলে বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

এসব বিষয় প্রস্তাবে না আসায় বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থেকেছে বলে মিশন জানিয়েছে।

এদিকে, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন রোববার ঢাকায় বলেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পাস হওয়া প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকাটা বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নয়। প্রত্যাশা অনুযায়ী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গটি না থাকায় ওই প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দেয়নি।

ভোট না দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ভোটদানে বিরত থাকার মাধ্যমে ভুল বার্তা দেওয়ার ‘প্রশ্ন উঠে না’।

বৈশ্বিক সংস্থার প্রস্তাবে ছাড় দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘জাতিসংঘে এত দেশ আছে যে সবাইকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে সবাইকে সঙ্গে রাখার জন্য কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট চাহিদা সেভাবে রাখা যায় না। এই প্রস্তাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিষয়টি ছিল। আমাদের বক্তব্য ছিল প্রস্তাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কিছু অনুচ্ছেদ রাখা হোক। এটা আমাদের চাহিদা ছিল। আমরা রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ চাই। এটা ছাড়া প্রত্যাবাসন সম্ভব না।’

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমাদের মনে হয়েছে, প্রস্তাবটি যথেষ্ট জোরালো নয়। তাই বিরত থেকেছি। আর এই বিরত থাকার পক্ষে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছি। এই বিরত থাকা মানে এটা নয় যে বর্তমান সামরিক সরকারকে সমর্থন করছি, তা নয়। এটা ভাবা ঠিক হবে না। আমাদের মূল অগ্রাধিকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।’

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন