• ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২৫শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

মৃত্যুতেও রহস্য রেখে গেলেন আবুল হারিছ চৌধুরী

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৫, ২০২২

তরুণ বয়সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। পরে জিয়াউর রহমানের জাগো দল হয়ে যোগ দেন বিএনপিতে। হয়ে উঠেছিলেন দলটির অন্যতম নীতিনির্ধারক। আর গত জোট সরকারের আমলে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব। হাওয়া ভবনের আশীর্বাদিপুষ্ট হয়ে দল ও সরকারের প্রভাশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন আবুল হারিছ চৌধুরী। যিনি হারিছ চৌধুরী নামেই পরিচিত।

২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেন উদ্ভূত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে বেকাদায় পড়েন হারিছ চৌধুরী। ক্ষমতা হাত ফসকে যায় তার। উল্টো দেশের শীর্ষ দুর্নীীতবাজের তালিকায় নাম ওঠে। আরও নানা অনিয়মর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সিলেটে বেড়ে ওঠা এই রাজনীতিকের নাম। তাকে ধরতে সিলেটের কানাইঘাটের গ্রামের বাড়িতে অভিযানও চালায় যৌথবাহিনী। কিন্তু হারিছ চৌধুরীকে পাওয়া যায়নি।

সেই থেকে লাপাত্তা হারিছ চৌধুরী। নেই তো নেই। কোথাও তার খোঁজ নেই। তাকে নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে তিনি সিলেটে, কেউ বলে ঢাকায়। আবার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য দিতে থাকেন কেউ কেউ। ভারত, ইরান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র—হারিছ চৌধুরীর অবস্থান সম্পর্কে একেক সময় একেক দেশের নাম শোনা যায়। তবে নিশ্চিত করে কোনো তথ্যই জানা যায় না। তার পরিবার মুখে খোলে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অবস্থান শনাক্ত করতে পারে না।

দিন গড়ায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেও নানা সময় আলোচনায় উঠে আসে হারিছ চৌধুরীর নাম। বিশেষত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ আলোচিত কয়েকটি মামলার আসামি হওয়ায় এসব মামলার শুনানিকালে তার নামও আলোচিত হতে থাকে। এই দুই মামলায়ই দণ্ড হয় হারিছ চৌধুরীর। তবু তার খোঁজ মেলে না। ২০০৭ সালের পর প্রকাশ্যে তাকে কেউ দেখছে বলেও জানা যায় না। এমনই রহস্যজনক অর্ন্তধান তার।

এবার তার মৃত্যু নিয়েও তৈরি হয়েছে রহস্য। দীর্ঘদিন অন্তরালে থাকায় এরআগেও কয়েকবার হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছিলো। তখন অবশ্য পরিবারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এবার পরিবারের পক্ষ থেকেই জানানো হলো মৃত্যুর খবর। গত মঙ্গলবার তার চাচাতো ভাই সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি আশিক উদ্দিন চৌধুরী ফেসবুকে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর জানান। তার দেওয়া তথ্য মতে, আরও তিনমাস আগেই নাকি মারা গেছেন হারিছ।

এবার প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কোথায় মারা গেছেন হারিছ চৌধুরী? আশিক চৌধুরী বলছেন, যুক্তরাজ্যে মারা গেছেন তিনি। তবে বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, ঢাকায় মারা গেছেন তিনি। দাফনও হয়েছে ঢাকাতে।

কেন তিনমাস ধরে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর তথ্য গোপন রাখা হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

হারিছ চৌধুরীর উত্থান

সিলেটের কানাইঘাটের দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গামের হারিছ চৌধুরী লেখাপড়া করেন ঢাকার নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুতে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যোগ দেন জাগোদলে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হারিছ চৌধুরীকে। বিএনপি গঠনের পর সিলেট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হন হারিছ। পরে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ ও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। তবে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী হন হারিছ। আর ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হারিছ চৌধুরীকে রাজনৈতিক সচিব করেন খালেদা জিয়া। ওই সরকারের আমলে ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠা হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর থেকেই শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে হারিছ চৌধুরীর ক্ষমতা ও সম্পদ। ভারী হতে থাকে অভিযোগের পাল্লাও।খবর সিলেটটুডে২৪

যেভাবে পালিয়ে যান

২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযান শুরু করলে আত্মগোপনে চলে যান হারিছ চৌধুরী।

পারিবারিক ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা যায়, সেনাসমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার সপ্তাহখানেক পর ঢাকা থেকে স্ত্রীকে নিয়ে সিলেটে গ্রামের বাড়িতে আসেন হারিছ। ওই রাতেই যৌথবাহিনী তার বাড়িতে অভিযান চালায়। তবে তাকে পায়নি।

সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য রয়েছে, হারিছ চৌধুরী জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রথমে ভারতে পালিয়ে যান। সেখান থেকে চলে যান ইরানে থাকা ভাইয়ের কাছে। ইরান থেকে লন্ডনে পরিবারের কাছে যান। এরপর তিনি দেশে এসেছেন বলে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।’ যুক্তরাজ্যে হারিছের স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা রয়েছেন।

তবে আত্মগোপনে যাওয়ার পর তাকে আর কখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। এমনকি দেশে থাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতেন না বলে তারা জানিয়েছেন।

ভারতে যাতায়াত করতেন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য দেখভাল করতেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বিভিন্ন সময় নিশ্চিত করে।

২০১৫ সালে হারিছ চৌধুরী গোপনে একবার দেশে এসেছিলেন বলে স্থানীয় বিএনপির একটি সূত্র দাবি করেছে। তবে এর সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই সূত্রের দাবি, ২০১৫ সালের পর থেকে দেশের কারো সঙ্গে হারিছ চৌধুরী আর যোগাযোগ রাখেননি। ওই সময়ে একবার তার মৃত্যুর গুজবও ছড়িয়ে পড়ে।

কী বলছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতারা

হারিছ চৌধুরী কখনো যুক্তরাজ্যে এসেছেন কি না, এ তথ্যই জানা নেই যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহদের। তিনি বলেন, ‘তিনি কখনো যুক্তরাজ্যে ছিলেন কি না বা এসেছিলেন কি না কোনো কিছুই আমাদের জানা নেই। তার মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকা মারফত জেনেছি।’

যুক্তরাজ্য স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রেস উইংয়ে থাকা এক সাংবাদিককে নিয়ে ৩ বছর আগে উত্তর লন্ডন ওয়াইলসডেন এলাকায় তার মেয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। পরিবার আমাদের আথিতেয়তা করলেও হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে কোন তথ্য দেননি। বাসায়ও উনাকে দেখিনি।

তবে সবচেয়ে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক। তার দাবি, হারিছ চৌধুরী কখনোই যুক্তরাজ্যে আসেননি।
হারিছ চৌধুরীর সাথে তার কয়েকদফা কথা হয়েছে বলেও দাবি করেন মালিক।

মৃত্যু কোথায়

আগে একাধিকবার হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর গুজব ছড়ালেও এবার সত্যিই তার মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পারিবারিক ও দলীয় একাধিক সূত্র। নির্দিষ্ট করে তারিখ জানা না গেলেও গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি মারা যান বলে জানা গেছে। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে মৃত্যুর স্থান নিয়ে। পরিবারের দাবি, হারিছ মারা গেছেন যুক্তরাজ্যে। আর দলীয় নেতাদের দাবি, ঢাকায়ই মারা গেছেন তিনি।

যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক বলেন, হারিছ চৌধুরী ৩ মাস আগে ঢাকায় মারা গেছেন। আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়েই বলছি।

একই ভাষ্য সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীমেরও। তিনি বলেন, আমি শুনেছি তিনি ঢাকায় মারা গেছেন। সেখানেই তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

তবে হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়টি জানলেও কোথায় মারা গেছেন তা জানেন না বলে দাবি করেছেন সিলেট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামরুল হুদা জায়গীরদার। কামরুল হুদা বলেন, মাস দুয়েক আগেই তার মৃত্যুর খবর জেনেছি। তবে কোথায় মারা গেছেন তা জানি না। কারো কাছে এটা জানতেও চাইনি।

দলের একজন সাবেক শীর্ষ নেতার মৃত্যুতে শোক বার্তা না দেয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরণের বিবৃতি না দতে বলা হয়েছিলো।

তবে হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই আশিক চৌধুরীর দাবি, ২০০৭ সালের পর আর কখনোই দেশে আসেননি হারিছ চৌধুরী। যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন। সেখানেই তার দাফন হয়েছে।

আশিক চৌধুরী জানান, গত বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাছি হারিছ চৌধুরী লন্ডনে করোনা আক্রান্ত হন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে তিনি বাসায় ফিরেন। কয়েকদিন পর তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভও আসে। করোনার দখল সাময়িক কাটিয়ে ওঠলেও তার ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। ফুসফুসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পরে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাজ্যের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান হারিছ চৌধুরী।

মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত নন ছোট ভাই

হারিছ চৌধুরীর পাঁচ ভাই। এরমধ্যে হারিছসহ তিনজন মারা গেছেন। বেঁচে আছেন দুজন। এদের মধ্যে আব্দুল মুকিত চৌধুরী থাকেন ইরানে। আর সবার ছোট কামাল চৌধুরী থাকেন কানাইঘাটে গ্রামের বাড়িতে। তবে বড়ভাইয়ের মৃত্যুর তথ্য এখনও নিশ্চিত করে জানেন না বলে দাবি করেছে কামাল চৌধুরী।

বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ফেসবুক ও পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি বড় ভাই মারা গেছেন। তবে নিশ্চিত করে জানি না।

কামাল চৌধুরী বলেন, মাস তিনের আগে ভাতিজি (হারিছ চৌধুরীর মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী) ফোন করে বলেছিলো বড় ভাই অসুস্থ। দোয়া করতে বলেছিলো। এরপর থেকে তাদের সাথে আর যোগাযোগ নেই। মৃত্যুর খবরও কেউ আমাকে দেয়নি।

হারিছ চৌধুরীর স্ত্রী জোসনা আরা চৌধুরী, ছেলে নায়েম শাফি চৌধুরী ও মেয়ে সামিরা তানজিন চৌধুরী যুক্তরাজ্যে রয়েছেন। ফলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন