ভবনটির সামনের খালি জায়গায় এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা আছে পুরনো গাড়ি আর গাড়ির যন্ত্রাংশ।
ভবনের প্রবেশপথও বন্ধ হয়ে গেছে গাড়িগুলোর কারণে। পাশেই চলছে গাড়ি মেরামত আর ধোয়ার কাজ। আরেকপাশে সিটি করপোরেশনের বন্ধ কেন্টিন।
অথচ ভবনটির উপরে ঝুলানো সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে- ‘পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার’। সাইনবোর্ডে পাঠাগার লেখা থাকলে এখন আর পাঠাগারের কোনো কার্যক্রম নেই এখানে।
বুধবার সিলেট সিলেট নগরের সুরমা নদীর তীরবর্তী তোপখানা এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো এমন চিত্র।
পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার সিলেট সিটি করপোরেশন পরিচালিত গণগ্রন্থাগার। চালু থাকা অবস্থায় এখানে প্রতিদিনই ভিড় করতেন পাঠকেরা। দিনভর পাঠক আড্ডা জমতো। তবে ৯ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে এই পাঠাগারটি। সাইনবোর্ড ছাড়া এখানে এখন আর পাঠাগারের কোনো অস্থিত্ব নেই। সাইনবোর্ডটিও উধাও হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিন আগে। তবে নাগরিকদের প্রতিবাদের মুখে সম্প্রতি সাইনবোর্ডটি ফিরে এলেও পাঠাগার ফিরেনি।
এই গ্রন্থাগারের ইতিহাস সম্পর্কে সিলেটের শিক্ষাবিদ ও লেখক ডক্টর আবুল ফতেহ ফাত্তাহ বলেন, এটি আগে ছিলো লোকনাথ রতন মনি টাউন হল। সিলেটের লোকজনের শিল্প-সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র ছিলো এটি। রবীন্দ্রনাথসহ অনেক বিখ্যাত মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে। বই এবং ছবির দুর্লভ সংগ্রহ ছিলো এই হলে। আমেরিকান লাইব্রেরি হিসেবে পরিচিত ইউজিসি লাইব্রেরিও ছিলো এখানে। পরে সিলেটের ইংরেজি শিক্ষার প্রতিকৃত রেবারেন্ড উইলিয়াম প্রাইস স্মরণে প্রাইস মেমোরিয়াল লাইব্রেরি চালু হয়। পাকিস্তান আমলে এই পাঠাগারের বই নিয়ে যাওয়া হয় সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। দেশ স্বাধীনের পর এখানে চালু হয় পৌর পাঠাগার। পরে প্রয়াত বাম রাজনীতিবিদ পীর হবিবুর রহমানের নামে এই পাঠাগারের নামকরণ করা হয়।
গণ পাঠাগারটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই পাঠাগারটি নগরবাসীর বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ও পাঠঅভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজ করছিলো। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এটি বন্ধ থাকায় নগরবাসী বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের পাঠঅভ্যাস নষ্ট হচ্ছে।
তিনি বলেন, সিলেট নগর থেকে খেলার মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চা সংকুচিত হয়ে পড়ছে। গণগ্রন্থাগার দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এ অবস্থায় আমাদের তরুণা যাবে কোথায়? বেড়ে উঠার সব পথ বন্ধ করে দিলে তারা তো বিপথে বাড়া বাড়াবেই।
দ্রুত পাঠাগারটি পুনরায় চালু করে সিলেটের মানুষের সাহিত্য পাঠের আশ্রয়টি মুক্ত করার দাবি জানান অধ্যাপক ফাত্তাহ।
সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) সূত্রে জানা যায়, বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও ’৫২-এর ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ সিলেটের আহ্বায়ক পীর হবিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০০৪ সালে সিলেট পৌর পাঠাগারকে পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার হিসেবে নামকরণ করা হয়। সিলেটের আরেক জাতীয় নেতা, দেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ এই নামকরণের প্রস্তাব করেন।
২০০৯ সালে ঐতিহ্যবাহী এই পাঠাগারের একতলা ভবন ভেঙ্গে পাঁচতলা ভবন নির্মান করে সিটি করপোরেশন।
এরপর ২০১২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের বহুতল ভবন নির্মানের জন্য পুরনো ভবন ভেঙে ফেলো হয়। তখন হবিবুর রহমান পৌর পাঠাগারে অস্থায়ীভাবে সিসিকের অফিস স্থানান্তর করা হয়। এসময় পাঠাগারের বইগুলো পাশ^বর্তী আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ভবন সারদা স্মৃতি হলে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘদিন স্তুপ করে অযতেœ ফেলে রাখার ফলে সবগুলো বই-ই এখন নষ্ট হয়ে গেছে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিসিকের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর স্থায়ী ভবনে নিয়ে আসা হয় সিসিকের কার্যক্রম। তবে স্থায়ী ভবনে আসার সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চালু হয়নি পীর হবিবুর রহমান পাঠাগার। এরমধ্যে সম্প্রতি পাঠাগারের সাইনবোর্ডও সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে ক্ষোভের মুখে দিন দুয়েক আগে নতুন করে আবার সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে।
বুধবার তোপাখানায় পৌর পাঠাগার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সিলেট সিটি করপোরেশনের নষ্ট হওয়া গাড়ি, গাড়ির যন্ত্রাংশ স্তুপ করে রাখা হয়েছে পাঠাগার এলাকায়। এসব নষ্ট গাড়িগুলো মেরামতের কাজ করছেন কয়েকজন। আর ভববনের নিচের দুই তলায় সিসিকের পরিবহন শাখাসহ কিছু শাখার কার্যক্রম চলছে। উপরের তলাগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে সিসিকের কর্মীদের আবাসন হিসেবে।
ভবনের সামনে গাড়ি মেরামত কাজ করা এক শ্রমিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, এখানে সিসিকের নষ্ট গাড়িগুলো মেরামত ও ধোঁয়ামোছার কাজ করা হয়। বছরখানেক ধরেই এই ওয়ার্কশপের কার্যক্রম চলছে বলে জানান তিনি।
ভবনটির গায়ে পীর ‘হাবিবুর রহমান পাঠাগার’ সাইনবোর্ডের উপরেই ‘নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’-এর সাইনবোর্ড ঝুলানো রয়েছে। তবে এর কোনোটিরই কার্যক্রম এখানে নেই।
এই পাঠাগার দীর্ঘদিনেও চালু না করে পীর হবিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে মন্তব্য করে ‘পীর হবিবুর রহমান স্মৃতি পরিষদের’ সভপতি সৈয়দ বেলায়েত হোসেন লিমন বলেন, পাঠাগার তো অনেকদিন ধরে বন্ধ রয়েছেই, কিছুদিন আগে ভবন থেকে পাঠাগারের সাইনবোর্ডটিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছিলো। আমরা প্রতিবাদ করায় সাইনবোর্ডটি আবার বসানো হয়েছে। তবে সেখানে পীর হবিবুর রহমানের নাম ভুলভাবে পীর হাবিবুর রহমান লেখা হয়েছে।
পীর হবিবুর রহমান পাঠাগারের সাইনবোর্ড অপসারণের অভিযোগে গত ৪ সেপ্টেম্বর নগরীতে বিক্ষোভ করে
‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন সিলেট’ নামের একটি সংগঠন।
এই সংগঠনের আহ্বায়ক মুকির হোসেন চৌধুরী বলেন, সিটি করপোরেশন দীর্ঘদিন ধরে পাঠাগারটি চালুর উদ্যোগ তো নিচ্ছেই না। উল্টো সাইনবোর্ড অপসারণ করে পাঠাগারটিই নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। ইতিহাসকে মুছে দিতে চাইছে।
তবে পাঠাগারটি শীঘ্রই চালু করা হবে বলে জানিয়েছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়র আরিফ বলেন, সিসিকের নতুন ভবন নির্মাণ কাজের জন্য পাঠাগারটি বন্ধ রাখা হয়েছিলো। নতুন ভবনে কার্যক্রম শুরু হলেও সবগুলো শাখা এখন্ও স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। তবে আমরা দ্রুতই সিসিকের সকল শাখা এই ভবন থেকে সরিয়ে পাঠাগারের কার্যক্রম শুরু করবো।
মেয়র বলেন, এই পাঠাগারটিতে যাতে মানুষজন আরও স্বাচ্ছন্ত্যের সাথে এবং আরও সুন্দর পরিবেশে পড়ালেখা করতে পারে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বইয়ের সংগ্রহও বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।
পাঠগারের সাইনবোর্ড অপসারণের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাইনবোর্ডটি অপসারণ করা হয়নি। ঝড়ে ফেলে দিয়েছিলো। আমরা আবার পুণঃস্থাপন করেছি।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন