সিলেট জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। বিগত কমিটিতে সদস্য পদেও ছিলেন।
নতুন কমিটিতে আরও ভালো পদ পেতে লবিংও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে চার বছরেও নতুন কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় পদ পাওয়ার নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে যায় তার। ছাত্রত্বও শেষ হয়ে গেছে।
হতাশ হয়ে সম্প্রতি বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ওই ছাত্রনেতা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ তরুণ বলেন,কলেজজীবন থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতি করছি। ভালো পদ-পদবি পাব সেই আশা ছিল। এমন আশায় সুযোগ পেয়েও চাকরিতে যোগ দেইনি বিয়ে করিনি। জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছি। অথচ কমিটি হবে-হচ্ছে করে আমাদের বুড়ো করে দিল ছাত্রলীগ।
জেলা ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। নানা বিতর্ক ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের অক্টোবরে এ কমিটি বিলুপ্ত করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তখনই নতুন কমিটির পদপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে জীবনবৃত্তান্ত চাওয়া হয়। এরপর চার বছর পেরিয়ে গেলেও নতুন কমিটি আর হয়নি।
কমিটিহীন অবস্থায় আছে সিলেট মহানগর ছাত্রলীগও। ২০১৫ সালে সবশেষ সংগঠনটির কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জেলা কমিটির মতোই মহানগর কমিটিও নানা অভিযোগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিলুপ্ত করা হয়। এরপর তিন বছরে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও গঠিত হয়নি নতুন কমিটি।
দল ক্ষমতায় থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় সিলেটে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগ। নেতৃত্বহীনতার কারণে ছোট ছোট বলয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে সংগঠনটি। কমিটি না থাকার সুযোগে ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।
এদিকে পদপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যেও বাড়ছে হতাশা।
ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য গত ১৩ মার্চ সিলেটে এসে কর্মীসভা করেন। সেখানে দ্রুত কমিটি গঠনের আশ্বাসও দেন তারা। এরপর সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের তৎপরতাও শুরু হয়। পদপ্রত্যাশী নেতাদের তালিকা নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে অজ্ঞাত কারণে আটকে যায় সে উদ্যোগ।
নেতারা বলছেন, করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া, লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধে সব কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় ছাত্রলীগের কমিটি গঠন হয়নি। চলমান শোকের মাসেও কমিটি দেয়া হবে না। সেপ্টেম্বরে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নতুন কমিটি আসতে পারে।
জেলা ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটির সভাপতি ছিলেন শাহরিয়ার আলম সামাদ।
তিনি বলেন, ‘কমিটি না থাকার কারণে সংগঠনের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ। নতুন সদস্য সংগ্রহও হচ্ছে না। পুরোনো নেতা-কর্মী, যারা ত্যাগী ও যোগ্য ছিল, তাদের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে কেউ অপরাধ করলেও কেউ দায়ভার নিচ্ছে না। ফলে সিলেটে ছাত্রলীগ অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সংগঠন অগোছালো ও নেতা-কর্মীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্তি
দলের একাধিক সূত্রে জানা যায়,নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ আর গ্রুপিংয়ের কারণেই আটকে আছে সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি।
সিলেটে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করেন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। নিজেদের পছন্দের লোকদের কমিটির শীর্ষ পদ পাইয়ে দিতে সবসময়ই লবিং-তদবির করে থাকেন তারা।
আগে সিলেটে ছাত্রলীগ দর্শন দেউড়ি গ্রুপ, তেলিহাওর গ্রুপ, টিলাগড় গ্রুপ ও কাশ্মীর গ্রুপে বিভক্ত ছিল। এই চার গ্রুপের নেতৃত্ব দিতেন যথাক্রমে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক রনজিত সরকার এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক বিধান কুমার সাহা।
ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়,সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের শীর্ষ চার পদ এই চার নেতার অনুসারীদের মধ্যে ভাগাভাগি করে দেয়া হতো। ফলে কমিটি নিয়ে তেমন ঝামেলা হতো না।
তবে কয়েক বছর ধরে এই চার গ্রুপ ভেঙে নতুন আরও কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বড় ভাঙন ধরেছে টিলাগড় গ্রুপে। এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ করা দুই নেতা আজাদুর রহমান আজাদ ও রনজিত সরকার বিভক্ত হয়ে আলাদা দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে। এ দুই গ্রুপের বিভক্তি সশস্ত্র বিরোধে রূপ নেয় মাঝে মাঝে।
এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদুর রহমান আসাদ, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি পীযূষ কান্তি দের অধীনে নতুন আরও কয়েকটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতারা জানান, নতুন নতুন গ্রুপের সৃষ্টি হওয়ায় কমিটি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সব গ্রুপের নেতারাই নিজেদের অনুসারীদের শীর্ষ পদে আসীন করতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সব নেতাদের সন্তুষ্ট করতে না পারায় আটকে আছে কমিটি গঠন। সুত্র সিলেটটুডে২৪
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও সিলেটের আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে সমন্বয় না হওয়ার কারণে নতুন কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার আলম সামাদ।
তিনি বলেন, ‘কমিটি ঘোষণা করে কেউ ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। সিলেটে ছাত্রলীগ অনেক গ্রুপে বিভক্ত থাকায় যোগ্য নেতাদের খুঁজতে ও সব গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে কমিটি দিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তা ছাড়া সিলেটে এখন আগের মতো জাতীয় পর্যায়ের নেতাও নেই, যার ওপর ভর করে কমিটি দেয়া যায়। এসব কারণে কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে।’
যা বলছেন পদপ্রত্যাশীরা
সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটির চার শীর্ষ পদ পেতে অন্তত ৩৫ জন নেতা চেষ্টা চালাচ্ছেন। এদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচিত অনেকেও আছেন।
প্রতিটি গ্রুপ থেকেই শীর্ষ চার পদের জন্য তাদের অনুসারী নেতাদের নাম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছে। নিজেদের বলয়ের নেতাদের পদ নিশ্চিতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এসব গ্রুপ পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগ নেতারা।
ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গত মার্চে সিলেট সফরে এলে তাদের বরণ করতে বিমানবন্দরে হাজির হন ছাত্রলীগের গ্রুপ পরিচালনাকারী সব আওয়ামী লীগ নেতারা। কমিটিতে নিজেদের বলয়ের অবস্থান সুসংহত করার জন্যই তারা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের খুশি করার চেষ্টা চালিয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
নেতাদের এ ছাড় না দেয়ার মানসিকতার কারণেও সিলেট ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
এ অবস্থায় আগামী ১ সেপ্টেম্বর সিলেট-৩ আসনে উপনির্বাচনের প্রচারে আবারও সিলেট আসছেন ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। তাদের সফরকে কেন্দ্র করে আবার সামনে এসেছে ছাত্রলীগের কমিটিহীনতার বিষয়টি। পদপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে উৎসাহ।
জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশীদের তালিকায় নাম রয়েছে নাজমুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘আগস্ট শোকের মাস। এই মাসে কোনো কমিটি হবে না। তবে আশা করছি সেপ্টেম্বরে নতুন কমিটি গঠন হবে। কমিটিতে নিশ্চয়ই যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে।’
কমিটি গঠনের বিষয়টি পুরোটাই কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর নির্ভর করছে জানিয়ে জেলা কমিটির আরেক সভাপতি প্রার্থী কনক পাল অরুপ বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সমন্বয় না হওয়ায় কমিটি হচ্ছে না। এতে করে নতুন নেতৃত্ব উঠছে না। সংগঠনও দুর্বল হয়ে পড়ছে।’
মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন ৮ থেকে ৯ জন নেতা। তাদের একজন কাওসার জাহান সৌরভ। তিনি বলেন, ‘আগস্ট মাসে কমিটি ঘোষণা হবে না। এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে সিলেট-৩ আসনে উপনির্বাচন। আমরা আশা করছি নির্বাচনের পরে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে।’
সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলাপ করতে ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন