সোহেল আহমদ গোয়াইনঘাট থেকে : সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার এলজিইডির সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাধিক প্রকল্পে কয়েক’শ কোটি টাকা লুটপাটসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে অবশেষে বদলি করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদের ২৪ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অন্যতম সহযোগি গুনধর এ প্রকৌশলী এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের মাষ্টার মাইন্ড হিসেবে পরিচিত এ প্রকৌশলী অবশেষে বদলি হয়েছেন। তার সীমাহীন লুটপাট, অনিয়ম এবং ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ায় অবশেষে টনক নড়ল কর্তৃপক্ষের। স্থানীয় জনসাধারণ এবং ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ ওঠার পর, তাকে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় বদলি করা হয়েছে।
সম্প্রতি সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক বিশাল কমিশন বানিজ্যের ফলে নির্মাণ প্রকল্পে ডুয়েলবার রড ব্যবহার না করেই নিম্নমানের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে । স্থানীয় জনগণের অভিযোগে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই অনিয়ম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। জনমনে প্রশ্ন ওঠে, এত নিম্নমানের কাজ কীভাবে পাশ হলো,সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীর নিরব ভূমিকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
স্থানীয় ঠিকাদার সুজন মিয়া বলেন, “ডুয়েলবার রড ব্যবহার ছাড়াই সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, যা নিয়মবহির্ভূত। এভাবে কাজ করে জনগণের অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। আমরা এই প্রকৌশলীর অপসারণসহ উপযুক্ত বিচার চাই।”
ঠিকাদার লোকমান বলেন, “প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম কোনো নিয়মকানুন মানেন না। তিনি কাজের মানের দিকে নজর না দিয়ে সবসময় ঠিকাদারদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন।”
স্থানীয় সুত্র জানায়, আওয়ামীলীগের দোসর এই গুণধর কর্মকর্তা নিজ অফিসের বাইরে সাইনবোর্ডে নিজেকে “উপজেলা প্রকৌশলী” হিসেবে উল্লেখ করে পরিচিতি দিলেও, প্রকৃতপক্ষে তিনি সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে বিভ্রান্ত ছিলেন। তিনি মুলত ক্ষমতার দাপটে পদমর্যাদার অপব্যবহার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট অফিসের একজন কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে জানান, তিনি মূলত একজন সহকারী প্রকৌশলী হলেও, দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে উপস্থাপন করছিলেন।
সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়মের খবর “সুরমা টাইমস” পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় সংবাদটি সাথে সাথে ভাইরাল হয়। সংবাদ উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার এবং অনিয়মের সঙ্গে রফিকুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় যে, তিনি দলীয় প্রভাব ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কয়েক কোটি টাকা লুটপাট করেছেন প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম।
রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঠিকাদারদের হয়রানি করার অভিযোগও উঠে। বিল পাশ করাতে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া, কাজে নানা অজুহাতে বাধা সৃষ্টি করা এবং সাইড ইঞ্জিনিয়ারদের বদলির হুমকি দেওয়া ছিল তাঁর স্বভাব। অনেক দক্ষ সাইড ইঞ্জিনিয়ার এখানে এসে টিকতে পারেননি, কারণ তারা তাঁর মনমতো চলতে রাজি ছিলেন না।
শত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১০ই নভেম্বর, ঠিকাদারদের একটি দল গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস ঘেরাও করে রফিকুল ইসলামের অপসারণ দাবি করে। ঠিকাদার সুজন মিয়া, লোকমানসহ উপস্থিত অন্যান্য ঠিকাদাররা সাংবাদিকদের সামনে অভিযোগ করেন যে, “রফিকুল ইসলাম তাঁর ইচ্ছেমতো কাজ করে এবং ঠিকাদারদের হয়রানি করে। তাঁর কারণে উপজেলায় উন্নয়নকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
ঠিকাদাররা আরও জানান যে, তিনি নিয়মিত সিলেট থেকে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে অফিসে আসতেন, যার দৈনিক খরচ এক থেকে দুই হাজার টাকা। এই ধরনের বিলাসী জীবনযাপন এবং অনৈতিক সুবিধা না পেলে ঠিকাদারদের হয়রানি করার অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে পুরনো।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযোগ থাকায় এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁকে আজমিরীগঞ্জে বদলি করা হয়েছে। বদলির নির্দেশনা আসার পর থেকে ঠিকাদার এবং এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত গোয়াইনঘাটের এলজিডির সহকারী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের মুঠো ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তৌহিদুল ইসলাম জানান, “লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা তা যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।” তবে, ঠিকাদারদের আন্দোলন এবং গণমাধ্যমে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন