বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার ১৭ আসামির মধ্যে ১০ জনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া এই মামলায় পিএসপির চেয়ারম্যানের অবসরপ্রাপ্ত গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ সাত জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গত ৭ জুলাই রাতে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর অভিযানে নামে সিআইডি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। কীভাবে তাদের আটক করা সম্ভব হলো?
রাকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা গল্পে যেকোনও তথ্য ছড়িয়ে দিতে, মানুষকে খুঁজে পেতে গোয়েন্দা মূসা ব্যবহার করতেন ভূত থেকে ভূতে পদ্ধতি। প্রথম জন তিন জনকে বলবেন, তারপর সেই তিন জন আরও তিন জনকে বলবেন। এভাবেই অর্জিত হবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। তেমনই একজন থেকে আরেকজন প্রশ্নফাঁসকারীর কাছে পৌঁছে গেছে গোয়েন্দারা।
প্রথমে তোলা হয় লিটন সরকারকে
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ৬ জুলাই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায়, গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (বিপিএসসি) কর্তৃক আয়োজিত ‘সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্র পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে ওই পরীক্ষার হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস করে প্রার্থী পরীক্ষার্থীর কাছে অর্থের বিনিময়ে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করেছে। এ নিয়ে গত ৭ জুলাই অভিযান পরিচালনার জন্য সোর্সের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় আসামি লিটন সরকারকে ঢাকার শ্যামলী এলাকা থেকে আটক করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, সহযোগী প্রিয়নাথ ও জাহিদের কাছ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেয়ে থাকে এবং প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে লিটন অভিযুক্ত প্রিয়নাথ ও জাহিদকে নির্দিষ্ট হারে অর্থ দেয়। ওই তথ্যপ্রাপ্তির পর আসামি প্রিয়নাথকে আটক করা হয়।
প্রিয়নাথ জানায়, সে অপর অভিযুক্ত জাহিদের কাছ থেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেয়ে থাকে এবং ওই প্রশ্ন ও উত্তরের বিনিময়ে সে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জাহিদকে দিতো। এরপর আসামি জাহিদকে আটক করা হয়। অভিযুক্ত জাহিদ জানায়, সে রংপুর জেলার জনৈক সুমনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র জোগাড় করতো এবং জাহিদ নিজে যে পরিমাণ টাকা গ্রহণ করতো তার একটা বড় অংশ সুমনকে দিতো।
অভিযোগ থেকে জানা যায়, আসামি নোমান সিদ্দীকী, শাহাদাত হোসেন ও জাহাঙ্গীর এ চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। তাদেরও আটক করা হয়।
শাহাদত হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার অপর সহযোগী আসামি মামুন এই চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। তাকেও আটক করা হয়। মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, এই চক্রের সঙ্গে নিয়ামুল নামক একজন ব্যক্তি জড়িত। তাকেও আটক করা হয়। নিয়ামুলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম সক্রিয় সদস্য খলিল। খলিল গত ৫ জুলাই বিপিএসসি কর্তৃক আয়োজিত সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছে।
এরপর আসামি খলিলকে পীরেরবাগ মিরপুর এলাকা থেকে আটক করা হয়। খলিল জানায়, তাকে এসব পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতো পিএসসির সহকারী পরিচালক আলমগীর। আলমগীর গত ৫ জুলাই নিয়োগ পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দীর্ঘদিন ধরে ফাঁস করে আসছে। তাকে মিরপুর এলাকা থেকে আটক করা হয়।
গ্রেফতার আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে জানা যায়, এই চক্রের অন্যতম মূলহোতা আসামি সাজেদুল ইসলাম। প্রযুক্তির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
পিএসসি কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছায় যেভাবে
সাজেদুল জানায়, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সে পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফরের কাছ থেকে সংগ্রহ করতো। সাজেদুল তার অন্য সহযোগী সাখাওয়াত ও সাইমের মাধ্যমে সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকরি প্রার্থী সংগ্রহ করে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়া করা বাসা বা হোটেলে জড়ো করতো। নিয়োগ পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগেই ওই পরীক্ষার হুবহু প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থের বিনিময়ে ওই পদের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের উত্তর বিতরণ করতো। গত ৫ জুলাই পরীক্ষার জন্য নিয়ামুল পল্টন ও খিলগাঁও এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে অনুরূপ কর্ম করেছে মর্মে জানায়।
সাজেদুলকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, সাজেদুল তার সহযোগীদের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের সংগ্রহ করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে এই চক্রের অন্যতম মূল সদস্য পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর কাছে সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর বিতরণ করেছে।
সাজেদুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাখাওয়াত হোসেন ও সাইম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। সাজেদুল থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, আসামি সৈয়দ আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামকে আটক করা হয়। সৈয়দ আবেদ আলী জানায়, আবু সোলেমান মো. সোহেল নামক এক ব্যক্তি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক আয়োজিত সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রার্থী সরবরাহ করতো এবং নিজেই বুথ পরিচালনা করতো। অপর অভিযুক্ত সোহেলকে আটক করা হয়।
গ্রেফতার সব আসামিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাব-এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে ওই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রকাশ এবং বিতরণকাজে পলাতক অভিযুক্ত নিখিল চন্দ্র রায়, মো. শরীফুল ইসলাম ভুইয়া, দীপক বনিক, মো. খোরশেদ কাজী, মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, মো. গোলাম আজিদু মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এ টি এম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৫০ থেকে ৬০ জন ব্যক্তি এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। সংঘবদ্ধ এই চক্র বিগত বছরগুলোর বিসিএসসহ পিএসসির বিভিন্ন গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অর্থের বিনিময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত মর্মে স্বীকার করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জুয়েল চাকমা এই প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা একজন থেকে খবর পেয়ে আরেকজনকে আটক করে অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার দেখিয়েছি। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন