• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

সিলেটে বিশেষ মার্কায় জমা হয় পাসপোর্ট, দালালের ভূমিকায় আনসার

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২৪
সিলেটে বিশেষ মার্কায় জমা হয় পাসপোর্ট, দালালের ভূমিকায় আনসার

মাসুদ আহমদ রনি :: বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য যেকোন ব্যক্তির পাসপোর্ট তৈরি করতে হয় দেশের বিভিন্ন জেলা বা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস থেকে।

বর্তমানে সারাদেশেই চলমান আছে ই-পাসপোর্টের কার্যক্রম।একজন ব্যক্তিকে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদনপত্র পূরণ করে নির্ধারিত ফি পরিশোধের পর পাসপোর্ট অফিসে সরেজমিনে এসে তৈরি করতে হয় ই-পাসপোর্ট। এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট সদস্যরা।বিশেষ মার্কায় কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই পাসপোর্ট করে দেন তারা।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে আগেরমত প্রকাশ্যে দালালচক্রের দেখা না মিললেও বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও দালালচক্র পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে গড়ে উঠা বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান ও নগরের বিভিন্ন ট্রাভেলস এজেন্সির বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন বা মার্কা দিয়ে অফিসের কর্তাদের ম্যানেজ করে পাসপোর্টের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।সেই সাথে আনসার সদস্যরাও পাসপোর্ট অফিসের অভ্যন্তরে ডিউটিরত অবস্থায় সমানতালে দালালি চালিয়ে যাচ্ছেন।

সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে গড়ে উঠা ১০-১২ কম্পিউটার দোকান ও শহরের বিভিন্ন মার্কেটের অন্তত কয়েকশত নামী বেনামী ট্রাভেলস এজেন্টরা পাসপোর্ট তৈরী ও নবায়নের কাজ অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজ করে থাকেন প্রকাশ্যেই।এসকল জায়গায় গিয়ে পাসপোর্ট তৈরীর কথা বললেই তারা নির্ধারিত ফির চেয়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি টাকা নিয়ে পাসপোর্টের কাজ করে থাকেন।

সিলেট নগরীর ইদ্রিস মার্কেট,সুরমা টাওয়ার, রংমহল টাওয়ারস্থ ট্রাভেলসে কর্মরতরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা একটা পাসপোর্ট ফরম ফিলআপ ও টাকা পেমেন্ট ও সার্ভিস দিয়ে সর্বোচ্চ তিনশত টাকা পাই।অথচ গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিতে হয় সরকার নির্ধারিত ফি থেকে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি।এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের মার্কা ও ভেরিফিকেশনে লাগে আড়াই হাজার টাকা।অর্থাৎ ৪৮ পৃষ্টার ৫ বছর মেয়াদি পাসপোর্ট এর জন্য একজন ক্লায়েন্টকে সর্বনিম্ন ৬৮০০ টাকা থেকে ৭০০০ টাকা খরচ করতে হয়।বইয়ের আকার ও মেয়াদে টাকার পরিমাণ বাড়ে।এই টাকা না দিলে পাসপোর্ট অফিসে তাদেরকে হয়রানি করা হবেই।কারণ টাকা দিলেই গ্রাহকের ইমেইলের জায়গায় বিশেষ ইমেইল দেওয়া হয়।এটিই পাসপোর্ট অফিসের বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন বা মার্কা।এটি নতুন কিছু না।এটি ওপেন সিক্রেট।

পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং ১০ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফিই গুনতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।

পাসপোর্ট অফিসের ১০৮ নাম্বার কাউন্টারে আবেদনপত্র প্রত্যখান হওয়া আহমদ হোসেন বাপ্পি বলেন, আমি নিজে নিজে আবেদনপত্র ও পেমেন্ট এর কাজ করেছি।এখানে আসার পর তারা আমার কাগজপত্র সংকট দেখিয়ে জমা নেন নি। আমি বুঝতে পেরেছি আমি তাদের মার্কার সিষ্টেমে আসিনি তাই এরকম হচ্ছে।দেখি যদি না হয় তবে কি করবো? তাদের মার্কার সিষ্টেমে আমি আসবো।কারণ আমার বিদেশ যেতে হলে পাসপোর্ট দরকার।

নতুন পাসপোর্ট করতে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে আসেন মশাহিদ আলী নামের এক ব্যক্তি। পাসপোর্টের আবেদন পত্র নিজে নিজে পূরণ করে অনলাইনে ফি পরিশোধ করেন তিনি। পরবর্তীতে পাসপোর্ট অফিসের ফরম জমা দেওয়ার ১০৮ নাম্বার কাউন্টারের সামনে যান মশাহিদ আলীসহ এই প্রতিবেদক। সেখানে দায়িত্বে থাকা পাসপোর্ট অফিসের এক কর্তা প্রায় ১৫ মিনিট মোবাইলে কথা বলা শেষ করে বিভিন্ন কাগজপত্র নেই এমন অযুহাতে তার আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। বললেন, আপনার কাগজপত্র ঠিক নেই। ঠিক করে নিয়ে আসেন তখন কাগজ জমা নিবো।

এরপর মূল ফটকের দায়িত্বে থাকা এক আনসার সদস্য আড়াই হাজার টাকা বিষয়টি সুরাহা করতে পারবেন বলে তাকে জানান। অনেক দেন দরবার করে শেষমেশ ২ হাজার টাকায় রফাদফা করতে রাজি হন তিনি। এরপর প্রত্যাখান হওয়া কাউন্টারে গিয়ে নিমিষেই সিল ছাপ্পর মেরে আবেদনকারী ব্যক্তির ফরমের ইমেইলের স্থানে বিশেষ মার্কা নিয়ে আসেন তিনি। এরপর ১০৩ নাম্বার রুমে গিয়ে ফিঙ্গার ও ছবি দিতে বলেন আনসার সদস্য পলাশ।

বললেন সেখানে দুলাল ফরাজী নামের আরেক আনসার সদস্য তাকে সহোযোগিতা করবেন। বিশেষ মার্কার জন্য এই পাসপোর্ট করতে আসা ব্যক্তি ২ হাজার টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তার পথ আটকে দিয়ে পিছু নেন আনসার সদস্য দুলাল ফরাজী ও পলাশ। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলয়ে চাইলে মুহুর্তেই ভোল পাল্টালেন দুজন। পরে মোবাইলে থাকা প্রমাণ দেখালে চুপসে যান তারা। এক পর্যায়ে আকুতি মিনতি করতে থাকেন নিরাপত্তার কাজে থাকা আনসার সদস্যরা।

পাসপোর্ট অফিসে মার্কা ও টাকা লেনদেন প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সিলেট চ্যাপ্টার’র সভাপতি ফারুক মাহমুদ সুজন বলেন,পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ লেনদেন ও মার্কার বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানে দূর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন সেখানে এই ধরনের কার্যক্রম সরকারকে বিতর্কিত করছে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানো উচিত।প্রয়োজনে গোয়েন্দা সংস্থা,দুদকের কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করা হোক দুর্নীতিবাজদের ধরতে।

পাসপোর্ট অফিসের মার্কার বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ বলেন, মার্কার বিষয়টি আমার জানা নেই।আমরা সকলকেই সমানভাবে সেবা দিয়ে থাকি।প্রতিদিনকার আবেদন প্রতিদিনই শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে আমাদের।কাগজপত্র ঠিক নেই বলে প্রত্যাখ্যান হওয়া ১০৮ নাম্বার কাউন্টারে টাকা দিলে তা কিভাবে তা গ্রহণ করা হয় এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি তিনি।বললেন,আমাকে একটু সময় দেন আমি এ বিষয়ে কাজ করছি।এরকম কাউন্টারে হলে তাকে আমরা সরিয়ে দিবো।

দালালের ভুমিকায় আনসার বাহিনীর সদস্য পলাশ ও দুলাল ফরাজীর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই ধরনের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।তাদেরকে এমনিতেই ছয় মাসের বেশি আমরা পাসপোর্ট অফিসে রাখিনা।পর্যায়ক্রমে তাদের অদলবদল হয়। তথ্যসূত্রে : সিলেট প্রতিদিন

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন