রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : প্রায় আট মাস যাবত কিডন্যাপহয়ে মানবেতর অনিশ্চিত জীবন করছে বরগুনার কাউছার কাজীর ১৩ বছরের শিশুপুত্র জিসান। ঢাকায় অবস্থান করা সিলেট থেকে বিতারিত ভয়ংকর অপরাধী সন্ত্রাসী মো. হামিদ মিয়া তাকে আটকে রেখে চালাচ্ছে অমানবিক নির্যাতন।
দীর্ঘদিন ছেলেকে ফেরত নিতে হামিদ মিয়ার সাথে সরাসরি যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে বরিশাল বরগুনার পাথরঘাটার কাউছার কাজীর এখন দিন কাটে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে। সন্ত্রাসী হামিদের ভয়ে মামলা দিতেও সাহস করেননি তিনি। সন্ত্রাসী হামিদ নানা সময়ে নিজে ও তার সহযোগীদের দিয়ে ফোন করিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখছেন জিসানের বাবাকে। হামিদের সহযোগিরা জিসানের পরিবারকে ফোন দেয়ার সময় এমন এমন ব্যক্তির নাম ভাঙিয়ে ফোন করেন যে, জিসানের বাবা কাউসার কাজী তাঁর ছেলেকে ফেরত নেয়ার উপায় খুঁজতে কারো সাথে আলোচনা করারও সাহস করেন না।
জিসানের ফুফা মো. নিজাম সিকদার জানান, ‘গত আষাঢ় মাসে জিসান কাজীকে নিয়ে ঢাকায় যান জিসানের বাবা কাউছার কাজী। কোন একটি কাজের সূত্রে কাউছার কাজী ও সন্ত্রাসী হামিদের সাথে পরিচয় ও সম্পর্ক হয় তার। তখন কাউছার কাজী হামিদের বাসায় তার শিশুপুত্র জিসানকে নিয়ে উঠেন। অতঃপর, জিসানকে দু’দিনের জন্য সন্ত্রাসী হামিদের কাছে রেখে অন্যত্র কাজে যান জিসানের বাবা। কাউছার কাজ থেকে ওই বাসায় ফিরে বাসা তালাবদ্ধ পান। শিশু জিসান ও হামিদকে খুঁজে না পেয়ে আশেপাশে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারেন, হামিদ বাসা ছেড়ে জিসান নিয়ে অন্যত্র কোথাও চলে গেছে। তারপর থেকে আর শিশুপুত্র জিসানকে খুঁজে পাননি জিসানের বাবা কাউছার কাজী ও তার আত্মীয় স্বজন। সন্ত্রাসী হামিদ আত্নগোপনে চলে গিয়ে তার ব্যবহৃত তিনটি নম্বর থেকে জিসানের বাবাকে ব্লক করে দেয়। তাছাড়া এই ভয়ংকর সন্ত্রাসীকে হোয়াটসঅ্যাপ ছাড়া কোন নম্বরে ফোন করে পাওয়া যায়নি বলেও জানান নিজাম সিকদার ও কাউছার কাজী।
সন্ত্রাসী হামিদ সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গেলে উঠে আসে তার অপকর্মের ভয়ংকর রুপ। অনুসন্ধানে জানা যায়, সন্ত্রাসী হামিদ ঢাকা, বরিশাল, বরগুনা, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন যায়গায় বহু মানুষের লক্ষ লক্ষ টাকা নানান কায়দায় আত্মসাৎ করেছে। কখনও ধার, কখনও ভয় ভীতি, কখনও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে, কখনও ব্যবসার কথা বলে ইত্যাদি বহুবিধ কায়দায় মানুষের সাথে প্রতারণা করে থাকে এই ভয়ংকর অপরাধী সন্ত্রাসী মো. আব্দুল হামিদ মিয়া। এই প্রতারক সন্ত্রাসীর আসল নাম মো. আব্দুল হামিদ মিয়া হলেও সে প্রতারণা করার সময় নিজেকে এস কে রুহেল নামে পরিচয় দেন। সন্ত্রাসী হামিদ মোবাইলে যেসব সিম ব্যবহার করেন তা কোনটিই তার নিজের নামে নেই বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এই সন্ত্রাসীর নামে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় অনেকগুলো অভিযোগ রয়েছে বলে হামিদের পারিবারিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সম্প্রতি সন্ত্রাসী হামিদ কতৃক প্রতারণার স্বীকার হয়ে সন্ত্রাসী মো. হামিদ মিয়াকে একটি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন মেসার্স এস এন এন্টারপ্রাইজ নামের ট্রান্সপোর্ট ও সাপ্লাই কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ব্যবসায়ী মো. নিয়াজ মাহমুদ। এই ব্যবসায়ীর পক্ষে ঢাকা জর্জ কোর্টের এক আইনজীবীর পাঠানো উকিল নোটিশে ছয় লক্ষ নব্বই হাজার টাকার প্রতারণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সম্পর্কে ব্যবসায়ী নিয়াজ মাহমুদ দৈনিক বাংলা ৭১কে জানান, আমার এক বন্ধু’র মাধ্যমে সন্ত্রাসী আব্দুল হামিদ মিয়ার সাথে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে আমার থেকে বিভিন্ন ধাপে ৯ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা ধার নেয়। যদিও আমার কাছে তার ব্যাংকে দেওয়া ৬ লক্ষ ৯০ হাজার টাকার বাইরে আর বাকী টাকার দালিলিক কোন প্রমাণ নেই। যা হাতে ও বিকাশে প্রদান করা হয়েছিলো।’ নিয়াজ জানান, ফেরত দেয়ার নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে গেলেও সে ফেরত না দিয়ে আমাকে উল্টো মেরে ফেলার হুমকি ধামকিসহ আমার জীবনে বেঁচে থাকার নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়। তাই আমি ভীতু হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। তিনি আরও জানান, ভাই আমি কোন সন্ত্রাসী হাতে মরতে চাইনা, আমার টাকা গুলো ফেরত চাই।’
অনুসন্ধানের প্রয়োজনে কথা হয় সিলেটের দুপাগুল ঈদগাহ বাড়ী এয়ারপোর্ট থানা নিবাসী সন্ত্রাসী হামিদের জন্মদাতা পিতা ও সিলেট এয়ারপোর্টের সাবেক দারোয়ান মো. ফজর আলী ওরফে বিরাই দারোয়ানের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদকের পরিচয় শুনে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘বাবা আমি খুবই অসুস্থ, হয়তো বেশি দিন বাঁচবো না, আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি আমার সাথে হামিদের কোন যোগাযোগ নাই, আমি ওই কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়েছি এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাপ। আজ থেকে আনুমানিক ১৫/১৬ বছর আগে এলাকার মানুষের নালিশের অত্যাচারে আমি হামিদকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করে বাড়ী থেকে বের করে দেই। হাজার হাজার মানুষের সাথে হামিদ প্রতারণা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেছে। আপনি কয়জনের কথা শুনবেন বাবা।’ সন্ত্রাসী হামিদের বাবা মো. ফজর আলী বিরাই আরও বলেন, ‘আগে ওর মায়ের সাথে মাঝে মাঝে কথা হতো হামিদের, এখন তাও হয় না। কিছুদিন আগে আমার বড় ছেলে মারা গেছে, ছোট আরেকটা ছেলে আছে সেটাও মানসিক প্রতিবন্ধী বাবা। আমি কিভাবে বেঁচে আছি জানি না। আপনারা পারলে ওকে ধরে জেলে দেন, আর যতো দ্রুত পারেন ওর কাছে যদি কোন বাচ্চা সত্যিই থেকে থাকে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে ওর বাবা-মার কাছে ফেরত দেন। বিরাই দারোয়ান আফসোস করে আরও বলেন, ‘আমি কবে মারা যাবো জানি না বাবা, কিন্তু আমি মরে যাওয়ার আগে যদি আমার কুলাঙ্গার সন্তান হামিদের মৃত্যু বা ওকে জেলে দেখে মরতে পারতাম তবে মরেও শান্তি পেতাম বাবা।’
এ বিষয়ে কথা হয়, হামিদের মামা ও সিলেট সদর উপজেলার ৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাজিমুদ্দিনের সাথে। তিনি জানান, হামিদের খোঁজে আমার কাছে সিলেট সদর ও এয়ারপোর্ট থানাসহ প্রায় নিয়মিতই বিভিন্ন থানার পুলিশ আসে। কিন্তু দুলাভাই (সন্ত্রাসী হামিদের বাবা) হামিদকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর থেকে হামিদের সাথে আমার কোন প্রকার যোগাযোগ নাই। নাজিম মেম্বার আরও বলেন, স্যার পারলে হামিদকে পুলিশ-র্যাব দিয়ে এরেস্ট করান, হামিদ অনেক পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ওকে এরেস্ট করালে অন্তত ভবিষ্যতে দেশের কিছু মানুষ ওর হাত থেকে রক্ষা পাবে। আপন মামা হয়ে বলতেও কষ্ট হচ্ছে, অনেকের ক্ষতির পাশাপাশি হামিদ নিজের পরিবারকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। ওকে ভাগিনা পরিচয় দিতেও আমার ঘৃণা ও অপমানবোধ হয়। আপনারা পারলে প্রশাসনের সহযোগিতায় বাচ্চাটিকে উদ্ধার করেন। তা না হলে ওর ভবিষ্যত নষ্ট করে দিবে হামিদ।’
সন্ত্রাসী হামিদের দ্বারা অপহরণের শিকার শিশুপুত্র জিসান কাজীর বাবা কাউছার কাজী কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে, ওই জালিম সন্ত্রাসী হামিদের হাত থেকে আমার ছেলে জিসানকে বাঁচান, তাকে ফেরত এনে আমার বুকে ফিরিয়ে দিন। আমি কতোদিন আমার কলিজার টুকরাটার মুখ দেখিনা।’ এক প্রশ্নের জবাবে জিসানের বাবা এই প্রতিবেদককে জানান, ‘ভাই আপনারা না বুঝেই শুধু মামলার কথা বলেন। আমি মামলা করছি শুনা মাত্রই ওই জালিম সন্ত্রাসী হামিদ আমার ছেলে জিসান বা আমাকে খুন করে ফেলবে।’
এদিকে, নিজের শিশুপুত্র জিসানকে ফিরে পেতে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তথা প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছেন অপহৃত শিশু জিসানের বাবা কাউছার কাজী ও তার পরিবার।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন