ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ও সিলেট সুনামগঞ্জ। দুটি জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ লাখ মানুষ। ঘরবাড়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮০ হাজারের উপর।
পানি কমলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লড়াই করছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। কর্মহীন হয়ে জীবন-জীবিকা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ।
কঠিন বিপদ কাটিয়ে জীবন বাঁচাতেই যখন হিমশিম খাচ্ছেন তারা তখন যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো এসে পড়ছে বিভিন্ন এনজিও’র ঋণের কিস্তি দেওয়ার চাপ।
প্রশাসনের নির্দেশনা উপেক্ষা করে এনজিও গুলো ঋণের কিস্তি আদায় করছে বলে অভিযোগ তাদের।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় কিস্তি আদায় চলছে আগের মতো। যদিও মাঠ কর্মীরা বলেছেন আমরা ঋণের জন্য চাপ দিচ্ছিনা। কেউ দিতে পারলে নিচ্ছি।
কেউ না দিতে পারলে চাপ দিচ্ছিনা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। অফিসার বাড়ীতে আসার পর কিস্তির জন্য এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছেন ঋণগ্রহীতারা।
সিলেট জেলা প্রশাসনের এনজিও শাখা সূত্রে জানা গেছে, সিলেট জেলায় ৩৭টির মতো এনজিও কাজ করলেও ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ৭টি প্রতিষ্ঠান। সিলেটে সাম্প্রতিককালের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় সিলেট জেলার সকল এলাকায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা ৩ মাস এনজিও গুলোর সবধরনের ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক।
কেউ কিস্তি আদায় করতে গেলে তার সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এনজিও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো: মেজবাহ উদ্দিন। কোন অজুহাতেই এই সময়ে কিস্তি নেয়া যাবেনা বলে জানান তিনি।
গ্রাহকদের নতুন ঋণ নিতে কৌশলে আগের বকেয়া পরিশোধের পরামর্শ দিচ্ছেন কতিপয় এনজিও মাঠকর্মী। এটিও ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা প্রশাসনের এই এনজিও কর্মকর্তা। তিনি বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান যদি নতুন ঋণ দিতে চায় সে দিতে পারবে।
তবে গ্রাহকের বকেয়া কিস্তি থাকলে সেটা সেপ্টেম্বর পরে নিতে হবে।
এদিকে একইভাবে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় এনজিও গুলোর সবধরণের ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু মাঠ পর্যায়ে কেউ মানছেনা এই নির্দেশনা। কৌশলে আদায় হচ্ছে কিস্তি।এ নিয়ে বাড়তি চাপে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষ।
জানা গেছে,সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায়
গ্রামীণ,ব্যাংক,ব্র্যাক,আশা,এফআইভিডিবি,টিএমএসএস,নিশান সোসাইটি সহ প্রায় ১০/১২ টি এনজিও প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
এসব এনজিও থেকে সাপ্তাহিক বা মাসিক কিস্তিতে ঋণ নিয়ে নৌকা,ভ্যানরিকশা,ইজিবাইক,থ্রি হুইলার সহ বিভিন্ন যানবাহন কেনার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করছে স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব বাহন চালিয়ে তা থেকে আয় করে জীবিকা নির্বাহ করেন ও ঋণের কিস্তি দেন তারা।
শহর ও গ্রামের প্রায় প্রত্যেক চা দোকানিরও একই অবস্থা। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি ও বিশাল ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার সংগ্রামে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষ এনজিওর ঋণের কিস্তি দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।
এদিকে ঋণের কিস্তি আদায়ে জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানছে না এসব এনজিও। তারা ঋণের কিস্তির জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাপ সৃষ্টি করছে ঋণগ্রহীতাদের ওপর।
গ্রামের নারীদের নিয়ে সমিতির মাধ্যমে চলছে এই ঋণ আদায়। পাড়ায় পাড়ায় টেবিল-চেয়ার পেতে ঋণগ্রহীতা নারীদের জড়ো করে চলে কিস্তি আদায়।
সিলেট ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এসব এনজিওকে জোর করে ঋণের কিস্তি আদায়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন ঋণগ্রহীতারা।
সিলেট নগরীর শামীমাবাদ কানিশাইল এলাকার এক সবজি ব্যবসায়ী জানান, তিনি স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ তুলেছিলেন।
ঋণ নেয়ার কয়েকমাস পরই বন্যায় নগরীর বিভিন্ন এলাকার সাথে পুরো শামীমাবাদ তলিয়ে যায়। টানা ১০ দিন বসবাসের বস্তি পানির নিচে ছিল।
বউ বাচ্চা নিয়ে বহু কষ্টে আত্মীয় স্বজনের বাসায় দিনাতিপাত করেছেন। পানি নেমে গেলেও ঘরের অধিকাংশ আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। পানি নেমে যাওয়ার পর পুঁজি না থাকায় তিনি সামান্য সবজি কিনে আবার বিক্রি করেন।
এ নিয়ে তারা খরচ পুষছেনা। এরমধ্যে প্রতি সপ্তাহে এনজিও কর্মীরা কিস্তির জন্য এসে পড়ে। তারা সরাসরি কিছু না বললেও সমিতির দলনেতার মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই ধার দেনা করে কিস্তি পরিশোধ করছেন।
এমন পরিস্থিতির শিকার নগরীর সুবিদবাজার এলাকার আকলিমা বেগম। তিনিও ভ্যানগাড়ী দিয়ে স্বামীর ছোটখাটো চা’এর দোকানের জন্য ব্রাক থেকে ২০ হাজার টাকা কিস্তি তুলেন।
বন্যার কারণে তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হন। বন্যার সময় স্বামীর ব্যবসা দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। বন্যার পানি কমে যাওয়ার সাথে কিস্তির চাপ শুরু হয়েছে।
রোববারও কিস্তি নিতে আসেন ব্রাকের ফিল্ড অফিসার।আকলিমা বলেন, সরকার বলছে ৩ মাস কিস্তি নেয়া বন্ধ,আপনারা নিতে আসছেন কেন? ঐ মাঠকর্মী বলেন কিস্তি বন্ধ শুধু গ্রামের এলাকার জন্য। শহরে কিস্তি আদায় চলতে বাধা নেই। এসব বলে মাঠকর্মীরা নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে চাপ দিয়ে আদায় করছে কিস্তি।
এমন পরিস্থিতি গ্রামেও। মঙ্গলবার সকালে সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাগলাবাজারে কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মীকে কিস্তি আদায় করতে দেখা গেছে।
এসময় কিস্তি দিতে আসা নারীদের কিস্তি না দিতে বললে সমিতির দলনেত্রী বলেন কিস্তি দিলে ‘ত’ ভালা। তাড়াতাড়ি পুরান কিস্তি শেষ অইবো আর তারা নয়া করি কিস্তি তুলতা পারবো।
জানা গেছে,সিলেট নগরীর প্রায় সব এলাকায় বিশেষ করে বস্তি ও কলোনীতে আগের মতোই চলছে কিস্তি আদায় কার্যক্রম।
এছাড়া সিলেট সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে, কোম্পানীগঞ্জ,জৈন্তাপুর,গোয়াইনঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই এনজিও ঋণের কিস্তি আদায়ের খবর পাওয়া গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলার প্রায় সকল উপজেলায় আগের মতো চলছে এনজিও’র কিস্তি আদায় কার্যক্রম।
এক্ষেত্রে তারা তুরুপের তাস বানাচ্ছে কথিত দলনেত্রীকে। সবগুলো এনজিও ঋণ দেয়ার আগে একটা সমিতি গঠন করে। সেই সমিতির একজন দলনেত্রী থাকেন। তার স্বাক্ষর ছাড়া কোন ঋণ ইস্যু হয়না। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে দলনেত্রীর উপর প্রতিষ্ঠানের চাপ থাকে।
তাই দলনেত্রীরা কিস্তি আদায়ে ভুমিকা পালন করে।
এ ব্যাপারে গ্রামীণ ব্যাংক সিলেটের জোনাল ম্যানেজার আবুল হোসাইন বলেন,আমরা এনজিও না ব্যাংক। আমাদের কিস্তি আদায় থেকে শুরু করে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
পাশাপাশি আমরা বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ সহ নানা সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। কিস্তি আদায় বন্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোন নির্দেশনা পাইনি।
আমরা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি ব্যাংকের মাধ্যমে এনজিওর মাধ্যমে নয়। তাই আমাদের কিস্তি আদায় বন্ধ করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা আসতে হবে।
কারণ সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) অসীম চন্দ্র বণিক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন,বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় সুনামগঞ্জ জেলায় সকল এনজিও’র কিস্তি আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
ব্রাক সিলেট জেলা কো-অর্ডিনেটর অনিক আহমদ অপু দৈনিক জালালাবাদকে বলেন,সিলেটের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি।খবর দৈনিক জালালাবাদ,
একই সাথে উনার সাথে আমাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। একই সাথে যাদের আমানত আছে তাদের আমানত ফেরত দেয়া এবং নতুন ঋণ বিতরণ চালু রাখতে নির্দেশনা দেয়া হয়।
আমাদের লোকজন মাঠে যাচ্ছেন তবে তা শুধু কিস্তি আদায়ের জন্য নয়। নতুন ঋণ বিতরণ ও আমানত ফিরিয়ে দেয়ার কাজও তারা করছেন। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিস্তি দিতে চায় সেটা কোন কোন কর্মকর্তা গ্রহণ করছেন।তবে কোন অবস্থাতেই কিস্তির জন্য চাপ দেয়া হচ্ছেনা।
সিলেট জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (এনজিও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত) মো: মেজবাহ উদ্দিন দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, জেলা প্রশাসক মহোদয় পুরোপুরিভাবে সকল এনজিও’র ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখতে বলেছেন। কোথাও কিস্তি আদায়ের প্রমাণ থাকলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন