ওয়েছ খছর:: সিলেটের হরিপুর। প্রখ্যাত আলেম হযরত আব্দুল্লাহ হরিপুরী (রহ:) স্মৃতিময় এলাকা এই হরিপুর। মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় সবকিছু। এজন্য হরিপুরকে সমীহ ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন সবাই।
কিন্তু হরিপুর বাজারের কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এলাকার সুনামে চিড় ধরতে চলেছে। টানা ১০ ঘণ্টার সংঘর্ষ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেন না কেউ-ই। যারাই সংঘর্ষ থামাতে গেছেন তারা উভয়পক্ষের কাছে হেনস্থার শিকার হয়ে ফিরে এসেছেন।
যখন লাশ পড়লো তখন শান্ত হলো হরিপুর।
কিন্তু রমজানের শুরুতে এমন ঘটনায় হতবাক সবাই। হরিপুরের এই দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছেন দুই ব্যক্তি। এরা হলেন- উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি ও ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ ও বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক আহমদ।
বাজারের নিয়ন্ত্রণ সহ আধিপত্য নিয়েই মূলত দু’জনকে ঘিরে রোববার রাতের ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। এখন পরিস্থিতি শান্ত। খুলতে শুরু করেছে হরিপুর বাজারের দোকানপাট।
ব্যবসায়ীরাও ফিরছেন বাজারে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি। হরিপুর বাজারে এক সময় প্রভাব ছিল আব্দুর রশিদ চেয়ারম্যানের। তিনি স্থানীয় ফতেহপুর ইউনিয়নের দুই বারের চেয়ারম্যান। দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি থাকার কারণে হরিপুর বাজারকে এক হাতেই নিয়ন্ত্রণ করেন রশিদ।
বাজারের ভেতরে রয়েছে আলোচিত এক পশুর হাট। বলা হয়ে থাকে চোরাই পশুর হাটবাজার। কিন্তু বাজার বৈধ। সরকার থেকে প্রতিবছর ইজারা দেয়া হয়। ফলে হাটে তোলা পশু বিক্রি হলেই বৈধ হয়ে যায়। গরু ও মহিষের জন্য ওই বাজার গোটা সিলেটে বিখ্যাত। এই বাজারে নিয়ন্ত্রণ ছিল আব্দুর রশিদের হাতে। তিনি ছিলেন অন্যান্য শরিকদের মতো একজন শরিক।
কিন্তু চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ছায়া দিতেন সবসময়।
পাশাপাশি বাজারের সবকিছু দেখতেন তিনি। সামাজিক নেতা হিসেবে তার বিচরণ ছিল। গেল ইউপি নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদের কর্তৃত্ব হারান আব্দুর রশিদ। এরপর একে একে সব কিছুর কর্তৃত্ব হারান তিনি। এই অবস্থায় নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রফিক আহমদ।
এরপর থেকে হরিপুর বাজার সহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আসে রফিক আহমদের। তার সঙ্গে রয়েছেন এলাকার রাজনীতিক জাকারিয়া মাহমুদ সহ আওয়ামী ঘরানার লোকজন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- হরিপুর পশুর হাটের কর্তৃত্ব নিয়েই মূলত এবারের বিরোধ।
আর এই বিরোধের জের ধরে রোববার মধ্যরাত থেকে পরদিন সকাল ৯ টা পর্যন্ত টানা ১০ ঘণ্টার সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে একজন হাফেজ নিহত হওয়া ছাড়াও শতাধিক আহত হন। তবে- পশুর হাট নিয়ে দ্বন্দ্ব মানতে নারাজ আব্দুর রশিদ। ব্যবসায়ীদের মতে; হরিপুর পশুর হাটের গেল বারের ইজারা ছিল মাদ্রাসার মুহতামিমের নামে। এই পশুর হাটের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির আশঙ্কায় গেলবার মুহতামিমের নামে পশুর হাট ইজারা দেয়া হয়। এবার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বসে মাদ্রাসার মুহতামিমের নামে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানে বাদ সেধেছেন হরিপুরের অদূরের এলাকা দরবস্তের লুৎফুর রহমান। তিনি পশুর হাট সাড়ে ৫৯ লাখ টাকায় ইজারা নিয়ে আসেন। স্থানীয়দের ধারণা; আব্দুর রশিদের ইন্ধনেই লুৎফুর রহমান এবার মাদ্রাসার প্রধানকে অগ্রাহ্য করে বাজার ইজারা নিয়েছেন।
এতে করে স্থানীয়দের প্রভাব ক্ষুণ্ন হওয়ার মনোভাব পোষণ করছেন তারা। এই থেকে রশিদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। আর ওদের নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ। তবে- বাজারের ইজারাদার লুৎফুর রহমান গতকাল বিকালে বাজারের ইজারার সঙ্গে সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদের ইন্ধন ও যোগাযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন- ‘আমি টেন্ডারে অংশ নিয়ে ইজারা হয়েছে।
পরে হয়তো অনেকেই সংযুক্ত হতে পারেন। সেখানে আব্দুল রশিদ থাকলেও থাকতেন পারেন। কিন্তু এই সময়ে তিনি সম্পৃক্ত নন। এদিকে- বাজারের ভেতরে কানাডা প্রবাসী হাজী নুরুল হকের জমি দুই কোটি টাকার বিনিময়ে নিজের নামে কিনেছেন আব্দুর রশীদ।
এই জমি কিনতে চেয়েছিলেন স্থানীয় হাউদপাড়া এলাকার নুরুল হকের স্বজনরাই। এতোদিন ইমতিয়াজ সহ নুরুল ইসলামের কয়েকজন স্বজন স’মিলের ওই জমি দেখভাল করছিলেন।
কিন্তু বেশি দামে ওই ভূমি কিনে নিয়েছিলেন আব্দুর রশিদ। গত রোববার ওই ভূমির দখল নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। আর এতে শেষ পর্যন্ত লাশ পড়লো। সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ জানিয়েছেন- জমি ক্রয় করার সময় ইমতিয়াজ সহ কয়েকজনের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। কেউ বাধা না দেয়ায় তিনি জমি কেনেন। এবং ওই জমিতে বালু ফেলতে নিষেধ করার কারণেই হামলা হয়েছে।
তিনি বলেন- এ ঘটনার পর নিহত হাফেজ সালেহ আহমদের ভাই থানায় মামলা দিতে গেলেও তার মামলা নেওয়া হয়নি। পুলিশের ভূমিকা রহস্যময় বলে জানান তিনি।
তবে- সার্বিক বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাকারিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন- পশুর হাট নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী সহ সমাজের মানুষের কোনো কথাই মানা হয়নি।
বরং বিষয়টিকে বিতর্কিত করতে কৌশলে ইজারায় হাত বসানো হয়েছে। আর নুরুল হকের স্বজনদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ভূমি দখলে নিতে বাজারের অর্ধশতাধিক দোকানে আগুন ও লুটপাট করা হয়েছে।
ওরা জোরপূর্বক সব দখল করতে যাওয়ার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে- হরিপুর বাজারের এসব ঘটনা নিয়ে বিব্রত জৈন্তাপুরের ১৭ পরগণার সালিশ ব্যক্তিরা।
সংঘর্ষের দিন তারা এলাকা গেলেও সংঘর্ষ থামাতে পারেনি। অবশেষে সোমবার রাতে গিয়ে তারা বাজার পরিদর্শন করে এসেছেন। ১৭ পরগনার সালিশ ব্যক্তিত্ব তোফায়েল আহমদ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন- আমরা বাজার পরিদর্শন করেছি। ব্যবসায়ীদের শান্তিপূর্ণ ভাবে ব্যবসার করার কথা জানিয়েছি। যেহেতু একজন মারা গেছেন; এখন আইন সব দেখবে।
তবে- এসব ঘটনা নিয়ে ১৭ পরগণার সালিশের ব্যক্তিরা বিব্রত বলে জানান তিনি। এদিকে জৈন্তাপুর থানার ওসি গোলাম দস্তগীর জানিয়েছেন- এ ঘটনায় পুলিশ বাড়ি হয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওরা এজাহার দিলে হত্যা মামলা নেওয়া হবে। এখন পরিস্থিতি শান্ত। এলাকার পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। খবর দৈনিক মানবজমিন।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন