• ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগের হোঁচট

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত নভেম্বর ১৩, ২০২১
ফাঁকা মাঠেও আওয়ামী লীগের হোঁচট

নিজস্ব প্রতিবেদক:এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্থানীয় অনেক নেতা নির্বাচন করলেও জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের দেখা যায়নি তাদের পক্ষে প্রচারে। অন্য দলগুলোও এই নির্বাচন নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।অন্যদিকে এই নির্বাচন ঘিরে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ। তৃণমূলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে নির্বাচন করা হয় প্রার্থী। যারা বিদ্রোহী হয়েছেন তাদের করা হয়েছে বহিষ্কার। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের দেখা গেছে মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাতে।এত সবের পরও ভোটে কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি ক্ষমতাসীন দলটি। দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বৃহস্পতিবার সিলেট বিভাগের ৪৩ ইউনিয়নের মধ্যে ২৩টিতে হেরেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ফাঁকা মাঠেও কেন হোঁচট খেতে হলো আওয়ামী লীগকে- এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে চলছে জোর আলোচনা।দলটির স্থানীয় নেতারা বলছেন, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল, বিদ্রোহী প্রার্থীদের থামাতে না পারা ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে নেতাদের দূরত্ব তৈরি হওয়াসহ বেশ কিছু কারণে বেশির ভাগ ইউনিয়নে পরাজয় মেনে নিতে হয়েছে নৌকার প্রার্থীদের।

সিলেট বিভাগের ৪৪টি ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাতের কারণে একটি ইউনিয়নের ফল স্থগিত করা হয়েছে। বাকি ৪৩ ইউনিয়নের মধ্যে ২০টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, ১২টিতে স্বতন্ত্র, ১০টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এবং একটিতে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বিজয়ী ১২ স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে ১০ জন আবার বিএনপির, দুজন জামায়াত নেতা।সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আলমগীর আহমদ। বিএনপির এই নেতা পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮১ ভোট। তার নিকটতম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইলিয়াসুর রহমানের পক্ষে গেছে ৩ হাজার ৮৭৯ ভোট। আর আওয়ামী লীগ মনোনীত মো. মুল্লুক হোসেন পেয়েছেন ২ হাজার ৬১ ভোট। এই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই নেতার মোট ভোট বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে ৬৫৯ বেশি। এভাবে বিদ্রোহী থাকা সব ইউনিয়নেই ভাগ হয়েছে আওয়ামী লীগের ভোট। সিলেট জেলার ১৫টি ইউনিয়নে বৃহস্পতিবার ভোট হয়। এর ১০টিতে ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দল থেকে বহিষ্কার করেও তাদের দমাতে পারেনি আওয়ামী লীগ।ফল ঘোষণার পর দেখা গেছে, ১৫ ইউনিয়নের ১০টিতেই পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ৫টি স্বতন্ত্র হয়ে লড়া বিএনপি নেতারা, ৪টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা ও একটিতে জামায়াত নেতা জয় পেয়েছেন।প্রার্থী বাছাইয়ে ভুলের কারণেও অনেক ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন বলে মনে করেন পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ইলিয়াসুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘প্রার্থী বাছাই যে ভুল ছিল, তা ফলাফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’এ অভিযোগ অবশ্য মানতে নারাজ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা কমিটির নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়।

যাকে সবচেয়ে যোগ্য ও জনপ্রিয় মনে করা হয়েছে, তাকেই মনোনয়ন দেয়া হয়েছে।’বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনে বেশির ভাগ ইউনিয়নে হেরে যাওয়ার প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান বলেন, ‘বিএনপির কথা ও কাজে মিল নেই। তারা ডুবে ডুবে জল খায়। প্রতীক দেয় না বটে, তবে প্রার্থী দেয় ঠিকই।’তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ ভোট দেয়নি বলে আমাদের অনেক প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেননি। প্রার্থীরা ভোট নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেননি। এটা তাদের ব্যর্থতা।’বিদ্রোহী প্রার্থীদের ঠেকাতে না পারা প্রসঙ্গে শফিক বলেন, ‘দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় সবাই এখন নিজেকে নেতা মনে করছেন। সবাই নির্বাচন করতে চান। মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়ে যান। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ছিলাম। তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছি। কিন্তু কাউকে তো আর জোর করে আমরা বসিয়ে দিতে পারি না।

প্রার্থী হওয়া তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার।’সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অনেক ইউনিয়নে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিল। কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কিতদেরও প্রার্থী করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে দলের উদ্যোগ ছিল দায়সারা। অনেক ক্ষেত্রে দলের নেতারা বিদ্রোহীদের মদদও দিয়েছেন। এসবের প্রভাবও পড়েছে ফলে।’জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির এই নেতা বলেন, ‘দল দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলের সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে নেতাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। নেতারা এখন আর জনসম্পৃক্ত নন। ফলে ভোটাররা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও দল আর নেতাদের ব্যর্থতায় ভোটে হারতে হচ্ছে।’এই নেতার বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে ভোটের ফলেও। সিলেটের সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নিজাম উদ্দিন।

কিন্তু ভোটে তিনি হেরে গেছেন জামায়াতের স্থানীয় নেতা আবদুল মনাফের কাছে।পুরো বিভাগেই ইউপি নির্বাচনের ফলে এমন উদাহরণ রয়েছে অনেক।সিলেট সদর উপজেলার ৫ ইউনিয়নের মধ্যে সিলেট সদর উপজেলার মোগলগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান হিরণ মিয়া, কান্দিগাঁওয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী জামায়াত নেতা আবদুল মনাফ, জালালাবাদে আওয়ামী লীগের ওবায়দুল্লাহ ইসহাক ও হাটখোলায় খেলাফত মজলিসের মাওলানা রফিকুজ্জামান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের মধ্যে ইসলামপূর পূর্ব ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা আলমগীর হোসেন আলম, তেলিখালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল ওয়াদুদ আলফু, ইছাকলসে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাজ্জাদুর রহমান, উত্তর রণিখাইয়ে আওয়ামী লীগের ফয়জুর রহমান ও দক্ষিণ রণিখাইয়ে আওয়ামী লীগের ইকবাল হোসেন ইমাদ বিজয়ী হয়েছেন।বালাগঞ্জের ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে সদর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মো. আব্দুল মুনিম, পূর্ব গৌরীপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান মুজিব, পশ্চিম গৌরীপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী আবদুর রহমান মাখন, বোয়ালজোড়ে আওয়ামী লীগের আনহার মিয়া, দেওয়ানবাজারে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির নাজমুল আলম ও পূর্ব পৈলনপুরে আওয়ামী লীগের শিহাব উদ্দিন জয় পেয়েছেন।মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের মধ্যে একটিতে বিজয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী।

উপজেলার সাগরনাল ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুন নূর, পূর্বজুড়ী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ওবায়দুল ইসলাম রুহেল, পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আনফর আলী, জায়ফরনগর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা মাসুম রেজা ও গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নে বিএনপি নেতা আব্দুল কাইয়ুম বিজয়ী হয়েছেন।সুনামগঞ্জের ছাতকের ১০ ইউনিয়নের মধ্যে চারটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। বাকি ৭টির মধ্যে ৩টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, দুটিতে স্বতন্ত্র হয়ে লড়া বিএনপি নেতা ও একটিতে জামায়াত নেতা বিজয়ী হয়েছেন।উপজেলার ছৈলা আফজালাবাদ ইউনিয়নে নৌকা প্রতীক নিয়ে গয়াছ আহমদ, গোবিন্দগঞ্জ সৈদেরগাঁও ইউনিয়নে সুন্দর আলী, কালারুকা ইউনিয়নে অদুদ আলম ও উত্তর খুরমা ইউনিয়নে বিলাল আহমদ বিজয়ী হয়েছেন।এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে ছাতক সদর ইউনিয়নে সাইফুল ইসলাম, দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নে জয়নাল আবেদীন ও জাউয়া বাজার ইউনিয়নে আব্দুল হক নির্বাচিত হয়েছেন।উপজেলার দোলারবাজার ইউনিয়নে বিএনপি নেতা নুরুল আলম ও চরমহল্লা ইউনিয়নে আবুল হাসনাত ও ইসলামপুর ইউনিয়নে জামায়াত নেতা সুফি আলম সোহেল জয় পেয়েছেন।সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এম আবুল হোসেন, নরসিংপুর ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী নুর উদ্দিন আহমদ, দোয়ারা সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল হামিদ, মান্নারগাঁও ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বিএনপি নেতা ইজ্জত আলী,

পান্ডারগাঁও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আব্দুল ওয়াহিদ, দোহালিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শামীমুল ইসলাম শামীম, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জহিরুল ইসলাম, বোগলাবাজার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মিলন খান এবং সুরমা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ হালিম বীর প্রতীক নির্বাচিত হয়েছেন।হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জে ৫টি ইউনিয়নের ৩টিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। একটিতে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী।

একটির ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে।আজমিরীগঞ্জ সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. আশরাফুল ইসলাম মোবারুল, সুত্র, সিলেট টুডে২৪, বদলপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সুসেনজিৎ চৌধুরী, কাকাইলছেও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মিসবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া ও শিবপাশা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. নলিউর রহমান তালুকদার বিজয়ী হন। সংঘর্ষের জেরে এই উপজেলার জলসুখা ইউনিয়নের ফল স্থগিত করা হয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন