দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের কৌশল নির্ধারণে প্রথম দিনের বৈঠকে বিএনপির শীর্ষ নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভোটে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তারেক রহমানকে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক মিটিয়ে ফেলার তাগিদ দিয়েছেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির পক্ষ থেকে চারটি শর্ত উত্থাপন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সংলাপের আহ্বান আসার মধ্যে মঙ্গলবার এই বৈঠক হলো।
বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এই বৈঠকে দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মিলিয়ে ৬২ জন অংশ নেন। যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
আনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠকে শেষ হওয়ার আগেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ দুই-তিনজন নেতা বেরিয়ে যান। এর পর বক্তব্য দেন ২৮ জন।
সব মিলিয়ে পাঁচ ঘণ্টা চলে এ বৈঠক। এরপর বৈঠকস্থলের বাইরে অবস্থানরত সাংবাদিকদের নিরাশ করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠকের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। এ সময় তিনি সংবাদকর্মীদের প্রশ্ন না করার অনুরোধ করেন।
তবে বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে জানিয়েছেন।
তারা জানান, বৈঠকের শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পরে কথা বলেন তারেক রহমান।
এরপর দলের ভাইস চেয়ারম্যান এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা বক্তব্য রাখেন।
সভায় নেতারা মূলত তিনটি বিষয়কে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
তারা জোর দিয়ে বলেছেন, প্রথমত, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে দরকার হলে আবার ২০১৩ সালের মতো কঠোর আন্দোলনে যাওয়া উচিত। তৃতীয়ত, আন্দোলন করতে ছাত্রদলকে শক্তিশালী করতে হবে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া ভোটে যেতে রাজি হয়নি বিএনপি ও তার জোট। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট ঠেকাতে সহিংস আন্দোলন করে তারা।
তবে জাতীয় পার্টি ও আরও কয়েকটি ছোট দলকে নিয়ে ভোট করে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা। আর সেই সরকার ৫ বছর মেয়াদও পূর্ণ করে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের ভোটে বিএনপি অংশ নেয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই আর ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফল করে তারা। তবে এই নির্বাচন নিয়ে তাদের ব্যাপক আপত্তি আছে।
প্রায় তিন বছর আগের সেই জাতীয় নির্বাচনের পর বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। আর এ জন্য আওয়ামী লীগ ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো ভোটে না যাওয়ার ঘোষণা আছে দলটির।
এই অবস্থায় সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চারটি শর্ত দেন। এগুলো হলো, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার।
এরপর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে বলেছেন, নির্বাচন হবে সংবিধান মেনেই।
বিএনপির নেতারা জানান, তাদের বৈঠকে বেশির ভাগ নেতাই আলোচনায় না গিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিএনপিকে মাঠে নেমেই ক্ষমতা আদায় করতে হবে। তার জন্য কঠোর আন্দোলনের পক্ষে যুক্তি দেন সবাই।
ছাত্রদলকে শক্তিশালী করা
সভায় উপস্থিত একজন ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ছাত্রদলের নতুন কমিটি নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানান। তারা দাবি করেন নতুন কমিটি দিয়ে ছাত্রদলকে শক্তিশালী করার। বলেছেন, মাঠে টিকে থাকতে হলে ছাত্রদলকে শক্তিশালী করতে হবে।
আগাম নির্বাচনের ধারণা
একাধিক নেতা তাদের বক্তব্যে বলেছেন, সরকার আগাম নির্বাচন দিতে পারে। এ কারণে বিএনপিকেও সব দিক দিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কার্যনিবাহী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের নির্বাচনি প্রস্তুতির জন্য যে বক্তব্য রাখেন সেটিকে তুলে ধরে ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে কয়েকজন ও উপদেষ্টা পরিষদের ৩ জন নেতা বক্তব্য রাখেন।
তারা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন,প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনি প্রস্তুতি নেয়ার ঘোষণায় আগাম নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সকল বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে আগাম নির্বাচন দিয়ে দিতে পারে। তাই বিএনপিকে আগাম নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই সব পরিকল্পনা করতে হবে।’
জামায়াত নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তে আসার তাগিদ
একাধিক নেতা জানান, এই বিষয়টি নিয়েও দলের সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণার পরামর্শ দেন একাধিক নেতা।
দুইজন ভাইস চেয়াম্যান ও উপদেষ্টা পরিষদের একজন সদস্যের মত হলো, স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক রাখা নিয়ে নতুন করে বিবেচনা করা উচিত।
একজন বিএনপি নেতা বলেন, ‘সরাসরি জামায়াতকে ছাড়ার প্রসঙ্গটি কেউ বলেননি। তাদের বক্তব্য ছিল, জামায়াত নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক মহলের ধারণা সামনে রেখে বিএনপিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াত,জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে জোট করে বিএনপি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জোট ছেড়ে দেয়ার পর তার দলে ভাঙন ধরে। এরপর বিএনপি জাতীয় পার্টির একাংশ ও অন্য তিনটি দলকে নিয়ে ভোটে যায়।
সেই নির্বাচনে বিএনপি বাজিমাত করলেও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে এই জোট নিয়ে বিএনপির ভরাডুবি হয়। সেই নির্বাচনের আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়ে যায় বিষয়টি।
আর বিএনপি শাসনামলে মুক্তিযুদ্ধের খুনি বাহিনী আলবদরের দুই শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পাঁচ বছরের মন্ত্রিত্ব বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণ হিসেবে প্রমাণ হয়।
ভোটে ভরাডুবির পর বিএনপি ১০টি কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে ৯টি কমিটিই এমন পরাজয়ের জন্য জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক থাকাকেই দায়ী করে।
তারা দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের পরামর্শ দেয়।
গত বছর বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাও জামায়াত ছাড়ার তাগিদ দেন।একপর্যায়ে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের সিদ্ধান্তও হয়।তবে পরে আবার বিষয়টি ঝুলে যায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা জানান, এই বৈঠকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদসহ তিন নেতা জামায়াত ইস্যুতে বৈঠকে বক্তব্য দিয়েছেন। তারা সরাসরি জামায়াতকে ছেড়ে দিতে বলেননি। তবে আকার ইঙ্গিতে বিএনপি জোটে জামায়াতকে না রাখার মতামত তুলে ধরেন।
বৈঠকে উপস্থিত সূত্র জানান, তারেক রহমান তার সিদ্ধান্ত না জানিয়ে সবার মতামত লিখে রাখার কথা জানান।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কৌশল নির্ধারণে বৈঠক আরও দুই দিন চলবে। এরপর বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসবে বলে জানিয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
সূত্র: নিউজবাংলা
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন