চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে করোনাভাইরাসের প্রায় দুই হাজার ৬০০ ডোজ টিকা চুরির নেপথ্যে উঠে আসছে স্থানীয় সংসদ সদস্য হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এবং তাঁর ভাই ফজলুল হক মহব্বতের নাম। অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, হুইপ সামশুলই মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেনকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতাল থেকে টিকা সরিয়ে নেন। এরপর মহব্বত গত ৩০ ও ৩১ জুলাই টিকার ডোজগুলো বিক্রি করেন। ডোজপ্রতি দাম নেন ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা। এরপর শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে হুইপের বাড়ির পাশে অবৈধ টিকাকেন্দ্র বসিয়ে অনিবন্ধিত ব্যক্তিদের শরীরে এগুলো পুশ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এভাবে সরকারি টিকা বিক্রি করে যেনতেনভাবে মানুষের শরীরে পুশ করার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ঘটনাকে দণ্ডনীয় অপরাধ আখ্যা দিয়ে তাঁরা বলেছেন, অস্বীকৃত ও অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় মানবদেহে টিকা পুশ করায় বিপুলসংখ্যক মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে টিকা নিয়ে করোনা মহামারির মধ্যেই দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, হাসপাতাল থেকে করোনার টিকা বের হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি জানতেন না তিনি। গণমাধ্যমে খবর আসার পর মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট মো. রবিউল হোসেনকে শোকজ করেছেন তিনি। অর্থাৎ ডা. সব্যসাচী নাথের অগোচরে হাসপাতালের সরকারি ফ্রি করোনার টিকা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন রবিউল। চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয় থেকে গঠন করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির কাছে রবিউলও স্বীকার করে বলেছেন, হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর নির্দেশে এই টিকা হাসপাতাল থেকে কাউকে না জানিয়ে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে নিজের বাড়ির পাশে হুইপের অবৈধ টিকাকেন্দ্র নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর নানা সমালোচনা ও তোপের মুখে হুইপ সামশুল হক এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। কিন্তু সরেজমিন অনুসন্ধানে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ও ধারণ করা স্থিরচিত্রে প্রমাণ হয়, হুইপ এ বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি নিজেও এই টিকাকেন্দ্রে গিয়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, অবৈধ টিকাদান কেন্দ্রে হুইপ সামশুল হক সশরীরে গত শুক্রবার গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বেশ কিছুক্ষণ অবস্থানও করেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে সরকার দেশে করোনার টিকা প্রয়োগ ও কার্যক্রমের একটি করণীয় বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন, নির্ধারিত কেন্দ্রে টিকাদান, টিকা দেওয়ার আগে চিকিৎসক-কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা, আবশ্যিকভাবে এইএফআই কিট রাখা, সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোধকল্পে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও অ্যাম্বুল্যান্স প্রস্তুত রাখা, টিকা গ্রহণের পর গ্রহীতাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখার ব্যবস্থাসহ আরো কিছু নির্দেশনা রয়েছে সরকারের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পটিয়ার বিভিন্ন বয়সী প্রায় দুই হাজার ৬০০ মানুষের শরীরে টাকার বিনিময়ে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। ফলে এসব মানুষ ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁঁকিতে পড়েছেন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা জানান, দেশে এখন পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত কেন্দ্রের বাইরে কোথাও টিকা দেওয়ার অনুমতি নেই। কারণ মানবদেহে টিকা পুশ করার আগে অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ে আগে থেকে পুরোপুরি প্রস্তুত রাখতে হয়। না হলে যেকোনো সময় জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এদিকে দুই দিন ফ্রি টিকা বেচাবিক্রির পর রবিবার হুইপের বাড়ির পাশের ঝুঁকিপূর্ণ এ অবৈধ টিকাকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের গঠন করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সোমবার সকাল থেকে পটিয়ায় গিয়ে দিনভর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। তদন্তে এ ঘটনায় হুইপ সামশুল হকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত শনিবার অবৈধভাবে টিকাদান শিবির চালুর এ ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয় থেকে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারির সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অজয় দাশ। কমিটির সদস্যসচিব চট্টগ্রাম জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আসিফ খান এবং সদস্য একই কার্যালয়ের মেডিক্যাল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. মো. নুরুল হায়দার।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘তদন্ত কমিটি আজ ঘটনাস্থলে গেছে। তদন্ত সম্পর্কিত কোনো তথ্য এখনো পাইনি। যাদের মাধ্যমে এই টিকা প্রদান করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ভ্যাকসিন প্রদান সংক্রান্ত জাতীয় কমিটিকে আমরা লিখিতভাবে জানাব। সরকার আগামী ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার আগেই পটিয়ার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নে যে টিকা দেওয়া হয়েছে, তা তারা করতে পারে না।’
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘সেখানে টিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তদন্ত কমিটির প্রধান ডা. অজয় দাশ বলেন, ‘ঘটনাটি অনেক বড়। আজকে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। যারা টিকাদানে জড়িত ছিল তাদের পাশাপাশি যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁদের সঙ্গেও আমরা কথা বলছি। রেজিস্ট্রেশন কার্ড থাকলে তা প্রকৃত না ভুয়া তা-ও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
সূত্র – কালেরকণ্ঠ
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন