‘আমার স্বামী কেন বিনা অপরাধে জেল খাটবে? যারা হামলা করলো, যারা আমাদের পুরো গ্রাম তছতছ করে দিলো তারা সবাই জামিন পায়, কিন্তু আমার স্বামী কেন পাবে না? আমার ছোট বাচ্চা কেন বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে?’
এই প্রশ্নগুলো সুনামগঞ্জের শাল্লার যুবক ঝুমন দাস আপনের স্ত্রী সুইটির।
ঝুমন হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। গত ১৬ মার্চের ওই স্ট্যাটাসের পর তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। ২২ মার্চ পুলিশ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার নামে মামলা করে।
তবে ১৭ মার্চ সকালে ঝুমনদের গ্রাম শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হামলা চালানো হয়। ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় গ্রামের অন্তত ৯০টি হিন্দু বাড়ি। ঝুমনের বাড়িতেও হামলা হয়। তার স্ত্রী সুইটিকে পিটিয়ে আহত করা হয়।
এই হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সবাই জামিন পেয়ে গেছে। কিন্তু ঝুমনের আজ পর্যন্ত জামিন হয়নি। প্রায় সাড়ে ৪ মাস ধরে তিনি জেলে। হাইকোর্টও ফিরিয়ে দিয়েছে তার জামিন আবেদন।
এ প্রসঙ্গে ঝুমন দাসের ভাই নুপুর দাস বলেন, ‘ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া কি হামলা-লুটপাটের চেয়েও বড় অপরাধ? যারা পুরো গ্রামে তাণ্ডব চালাল, গ্রামের সব বাড়ি ভাঙচুর করল তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া সবাই জামিন পেয়ে গেছে। অথচ আমার ভাই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সাড়ে ৪ মাস ধরে জেলে আছে।’
ভালো নেই ঝুমনের মা
ঝুমনের মা নিভা রানী দাস বলেন, ‘বালা নাইরে বাবা। বালা থাকতাম কিলা কও? কত কোর্টে দৌড়াইলাম। ঢাকায় হাইকোর্টেও গেলাম। তবু ছেলেটার জামিন মিলছে না। এতদিন ধরি ছেলে জেলে।
‘কোনো অপরাধ না করিয়াও জেলে। আমি বালা থাকতাম কিলা কও। চউখে কুনু পথ দেখরাম না। সবরে জামিন দেয়া অইলো। কিন্তু আমার ছেলেরে কেনে আটকাইয়া রাখা অইলো। কিতা করলে যে তারে বার করি আনতে পারমু তা বুঝতে পাররাম না।’
সুইটির সংসারে স্বামীই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দরিদ্র স্বামীর কোনো সঞ্চয় নেই। তাই স্বামী জেলে যাওয়ার পর ১১ মাসের ছেলেকে নিয়ে শাশুড়ি-ভাসুরের সঙ্গে আছেন তিনি।
সুইটি জানান, শাশুড়ির সঙ্গে আছেন। খাওয়া-পরার কোনো সমস্যা নেই। তারপরও তো কত সমস্যা আছে। সব কথা তো বলা যায় না।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে আদালত ঝুমনের জামিন আবেদন খারিজ করে দিচ্ছে।
কিন্তু সুইটির প্রশ্ন, ‘সরকার কেনে নিরাপত্তা দিতে পারবে না? সবের নিরাপত্তা তো সরকারে দিবো। তাইলে আমার স্বামীর কেনে নিরাপত্তা থাকতো না?’
১৬ মার্চ রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ পর্যন্ত একবার ঝুমনের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছে তার পরিবার। গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে। করোনার কারণে এখন কারাগারে স্বজনদের দেখা করা বারণ।
যে কারণে গ্রেপ্তার ঝুমন
গত ১৫ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে শানে রিসালাত সম্মেলন নামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এতে হেফাজতের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আগে থেকেই সমালোচনায় ছিলেন মামুনুল হক। দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সংগঠনের নেতা-কর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েন। এ অবস্থায় দিরাইয়ের সমাবেশে এসে সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন তিনি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সমাবেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে সাম্প্রাদায়িক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেন মামুনুল।
এই সমাবেশের পরদিন ১৬ মার্চ মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন দিরাইয়ের পার্শ্ববর্তী উপজেলা শাল্লার নোয়াগাঁওয়ের যুবক ঝুমন দাস আপন। স্ট্যাটাসে তিনি মামুনুলের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগ আনেন।
মামুনুলের সমালোচনাকে ইসলামের সমালোচনা বলে এলাকায় প্রচার চালাতে থাকে তার অনুসারীরা। এতে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে নোয়াগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা ১৬ মার্চ রাতে ঝুমনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
এরপর রাতেই স্থানীয় বাজারে হেফাজতে ইসলামসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে প্রশাসন। এ সময় ঝুমনকে আটকের খবর জানিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। প্রশাসনের আহ্বানে তখন শান্ত থাকার আশ্বাস দেন উপস্থিত সবাই।
‘ফেসবুক স্ট্যাটাস কি হামলার চেয়েও বড় অপরাধ’
শাল্লার নোয়াগাঁওয়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলার পরের ছবি।
তবে পরদিন ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর সকালে কয়েক হাজার লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে হামলা চালায় নোয়াগাঁও গ্রামে। তারা ভাঙচুর ও লুটপাট করে ঝুমন দাসের বাড়িসহ হাওরপাড়ের হিন্দু গ্রামটির প্রায় ৯০টি বাড়ি, মন্দির।
১৬ মার্চ আটকের পর ১৭ মার্চ ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঝুমনকে আদালতে পাঠায় শাল্লা থানা পুলিশ। এরপর ২২ মার্চ ঝুমনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে শাল্লা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল করিম।
হামলাকারীরা জামিনে, ঝুমন জেলে
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় হেফাজতের তাণ্ডবে সমালোচনার মুখে পড়েন দলটির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক।
এর মাঝে ৩ এপ্রিল এক নারীসহ নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে গিয়ে জনরোষে পড়েন তিনি। সমালোচনা আরও বেড়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীও সংসদে মামুনুল হকের সমালোচনা করেন।
এরপর সহিংসতাসহ নানা অভিযোগে মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। রিমান্ডের পর তিনি এখন কারাগারে।
এদিকে শাল্লায় হামলার ঘটনায় শাল্লা থানার এসআই আব্দুল করিম, স্থানীয় হাবিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদার বকুল ও ঝুমন দাসের মা নিভা রানী তিনটি মামলা করেন। তিন মামলায় প্রায় ৩ হাজার আসামি। পুলিশ নানা সময়ে শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তারা সবাই এখন জামিনে।
ইউপি চেয়ারম্যান বিবেকানন্দ মজুমদারের করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয় দিরাই উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শহীদুল ইসলাম স্বাধীনকে। তার নেতৃত্বেই হামলা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। গ্রেপ্তারের পর এই মামলার তিন আসামি স্বাধীনের বিরুদ্ধে আদালতে স্বীকারোক্তিও দেন।
গত ২১ জুন সুনামগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে স্বাধীনও জামিনে মুক্তি পান।
কোথাও মিলছে না ঝুমনের জামিন
ঝুমন দাসের জামিনের জন্য প্রথমে হাকিম আদালতে আবেদন করে পরিবার। আদালত তা খারিজ করে দেয়। এরপর গত ১৬ মে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করা হয়। সেখানে জামিন না পেয়ে পরিবার যায় উচ্চ আদালতে। উচ্চ আদালতও ঝুমনকে জামিন দেয়নি।
ঝুমনের আইনজীবী দেবাংশু শেখর দাস বলেন, ‘আমরা আবার জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেছি। গত বৃহস্পতিবার শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। রোববার শুনানি হবে। আমরা আশাবাদী আদালত আবেদন বিবেচনা করবে।’
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী মৃত্যুঞ্জয় ধর ভোলা বলেন, ‘ঝুমনের জামিনের জন্য আমরা অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু কোথাও জামিন মিলছে না। বারবার ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে।
‘ঝুমনের গ্রামে হামলাকারীরা জামিন পেল কিন্তু নির্দোষ ঝুমন কেন পাবে না? এটা খুবই অমানবিক। আমরা তার জামিন চাই।’
মৃত্যুঞ্জয় ধর আরও বলেন, ‘শুনেছি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ঝুমনের জামিন দেয়া হচ্ছে না। এটা একেবারেই ঠুনকো কারণ। সব নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নিরাপত্তার কথা বলে কাউকে জেলে রাখা খুবই অমানবিক
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন