আন্তর্জাতিক ফুটবল মৌসুমের যবনিকা এর চেয়ে ভালোভাবে আর পড়তে পারতো কি? অনেকেই ভ্রু-কুঁচকে তাকাবেন। আন্তর্জাতিক ফুটবল মৌসুম তো শেষ হচ্ছে ইতালি-ইংল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে রোববার রাতে। কোপা আমেরিকার ফাইনাল কী করে যবনিকা হয়!
কথাটা ঠিক। ফিফা ক্যালেন্ডার ইউরোর ক্যালেন্ডার শেষ হলেও, বিশ্বের অধিকাংশ ফুটবল ভক্তের মৌসুম শেষ হচ্ছে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচ দিয়ে। দক্ষিন আমেরিকার ফাইনাল নিয়ে পরিষ্কার দুটো ক্যাম্পে ভাগ হয়ে গেছে ফুটবল বিশ্ব।
এক দল চান ‘দ্য বিউটিফুল গেমের’ উদ্ভাবক ও ফুটবলের দেশ ব্রাজিলের হাতেই উঠুক টানা দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা শিরোপা। অন্যরা চান শিরোপা জিতে ২৮ বছরের অভিশাপ মোচন করুক আর্জেন্টিনা ও তাদের অধিনায়ক।
দুই দল অবশ্য এতটা আবেগে ভেসে যাচ্ছে না। হৃদয়ের বাঁধভাঙ্গা আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মনোযোগ মাঠের ফুটবলে। শিরোপা জেতার কৌশল, প্রতিপক্ষকে ঠেকানোর ফাঁদ ও নিজেদের নিরাপদে রাখা এসব নিয়েই গলদঘর্ম আর্জেন্টিনার লিওনেল স্কালোনি ও ব্রাজিলের লিওনার্দো তিতে।
আর্জেন্টিনার হেড কোচ স্কালোনি ফাইনালের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, এত বড় ম্যাচ হলেও বিষয়টা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই।
তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ আমরা সবাই জানি। কিন্তু সহজভাবে নিতে হবে। সাবধান থাকতে হবে। অবশ্যই জেতার জন্য যা কিছু করা দরকার সবই আমরা করব। আমি ছেলেদের নিয়ে গর্বিত।’
লিওনেল মেসির দল পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেই ফাইনালে এসেছে। চার গোলের পাশাপাশি ৫টি অ্যাসিস্ট মেসির। ফাইনালে নিশ্চিত ভাবেই নিজেদের তালিসমানের দিকে তাকিয়ে থাকবে আর্জেন্টিনা। শিরোপা জিতলে অমরত্ব আর হারলে বরাবরের মতো স্বদেশিদের কাছ থেকে কটূকথা শুনতে হবে সর্বকালের সেরাদের একজনকে।
স্কালোনি অবশ্য এসবের ধার ধারেন না। মেসিকে নিয়ে কোচ বলেন, ‘ওকে কোনো কিছু জিতে কিছু প্রমাণ করতে হবে না। আমরা জানি আর্জেন্টিনা দলে মেসির কী ভূমিকা। কোনো কিছু না জিতলেও সে আমার চোখে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়।’
ফাইনালে আর্জেন্টিনা সম্ভাব্য সেরা দলটিই নামাচ্ছেন। অভিজ্ঞতার চেয়ে ফর্মের ওপরই জোর দিচ্ছেন স্কালোনি। যার ফলে সার্হিও আগুয়েরো ও আনহেল দি মারিয়ার বদলে তুলনামূলক কম অভিজ্ঞ কিন্তু ছন্দে থাকা নিকোলো গনসালেস ও পাপু গোমেসকে নামাবেন তিনি।
ডিফেন্সে আর্জেন্টিনার সেরা ডিফেন্ডার ক্রিস্টিয়ান রোমেরো দলের সঙ্গে অনুশীলন করলেও, এখনও শতভাগ ফিট নন। ফলে তার জায়গায় ফাইনালে দেখা যেতে পারে হারমান পেসেলাকে।
ব্রাজিলের ঐতিহাসিক মারাকানায় হচ্ছে ফাইনাল। এই মাঠেই জার্মানির কাছে ২০১৪ বিশ্বকাপের শিরোপা হারায় আলবিসেলেস্তেরা। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না স্কালোনি।
তিনি বলেন, ‘এটা ফাইনাল ম্যাচ। বুয়েনোস আইরেস, বা চিলির সান্তিয়াগো বা অন্য কোনো খানেই হোক আমাদের সেখানে খেলতে হতো। এটা কিংবদন্তির একটা ভেন্যু কিন্তু আমাদের নিরপেক্ষ ভেবে খেলতে হবে।
‘আমরা ব্রাজিলকে নিয়ে বিশ্লেষণ অরেছি তাদের দলের দুর্বলতা খোঁজার চেষ্টা করেছি। এটা আরেকটা ম্যাচ। যেটা শেষ হলে জীবন তার গতিতেই চলবে।’
১৪ বছর পর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দিদের মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের সেরা দল হিসেবেই শিরোপা লড়াইয়ে তারা। মেসির মতো ব্রাজিলের সেরা তারকা নেইমারও দেশের হয়ে কোপা শিরোপা জেতেননি।
২০১৯ চোতের কারণে খেলতে পারেননি। মাঠের বাইরে বসে দলের জয় দেখতে হয়েছে। রক্ষণভাগ থেকে আক্রমণভাগ। পুরো মাঠে ব্রাজিলের দুর্বলতা চোখে পড়েনি টুর্নামেন্টে।
লাল কার্ড পাওয়া গাব্রিয়েল জেসুস না খেললেও তার জায়গায় এসে ঠিকই সাফল্য পেয়েছেন লুকাস পাকেতা। আর্জেন্টিনার ধীরগতির ডিফেন্সে ওপর পুরো শক্তি নিয়েই ঝাঁপাবেন নেইমার, রিচার্লিসন, পাকেতারা।
আর প্রতিপক্ষের প্রাণ ভোমরা মেসিকে অকার্যকর করে তোলার পরিকল্পনা এঁটেছেন তিতে। ফাইনালে আগে সংবাদ সম্মেলনে ব্রাজিলের মিডফিল্ডার কাসেমিরো বলেন দলীয় ভাবেই মেসিকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা থাকবে তাদের।
কাসেমিরো বলেন, ‘মেসি যেখানে খেলে, আমিও সেই জোনে খেলি। বহু ম্যাচে পরস্পর পরস্পরের মোকাবেলা করেছি। একা কোনো খেলোয়াড়কে আমার পক্ষে মার্কিংয়ে রাখা সম্ভব না। সতীর্থদের সাহায্য দরকার। একা মার্কিংয়ে মেসিকে রাখা সম্ভব না।’
কোপা আমেরিকায় চারজন গোলস্কোরার পেয়েছে ব্রাজিল। অধিনায়ক নেইমারকে আক্রমণভাগে সহায়তা করেছেন রিচার্লিসন, পাকেতা ও রবার্তো ফিরমিনো। রক্ষণে আছেন থিয়াগো সিলভা, দানিলো ও মার্কিনিয়োসের মতো অভিজ্ঞরা।
সব মিলিয়ে ফেভারিট হিসেবে কোপার ফাইনালে মারাকানায় নামছে ব্রাজিল। ফরোয়ার্ড রিচার্লিসনের কথাতেও পাওয়া গেল তার আভাস।
তিনি বলেন, ‘আমরা পারব। এটি কথার কথা নয়, মাঠেও এর প্রমান দিতে পারব। আমরা তাদেরকে উত্তেজিত করে তুলব। সেটি সম্ভব।’
মারাকানায় একবারই বড় কোনো ফাইনাল হেরেছে ব্রাজিল। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে ওই হার ছিল ব্রাজিলের জন্য জাতীয় ট্র্যাজেডি। এবারের মেসির দলের কাছে আরেকটি ট্র্যাজেডি এড়াতে সর্বশক্তি দিয়েই চেষ্টা করবে সেলেকাওরা।
মেসির অমরত্ব নাকি ফুটবল রাজত্বে নেইমার যুগের শুরু? ব্রাজিলের ধারাবাহিকতা নাকি আর্জেন্টিনার শাপ মোচন? কে জিতবে কোপা আমেরিকার ফাইনালে সেটা দেখার অপেক্ষা আর কয়েক ঘণ্টা।
২০০৭ সালের পর প্রথমবার কোনো ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। মারাকানায় ম্যাচ শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায়।
সম্ভাব্য একাদশ
ব্রাজিল: এডারসন, দানিলো, থিয়াগো সিলভা, মার্কিনিয়োস, আলেক্স সান্ড্রো, কাসেমিরো, ফ্রেড, রিচার্লিসন, পাকেতা, এভারটন ও নেইমার।
আর্জেন্টিনা: এমিলিয়ানো মার্তিনেস, মোলিনা, পেসেলা, ওতামেন্ডি, তালিয়াফিকো, রদরিগো দি পল, লিয়ান্দ্রো পারেদেস, জোভানি লো সেলসো, লিওনেল মেসি, লাউতারো মার্তিনেস ও পাপু গোমেস।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন