• ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ৪ঠা জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

সিলেটের ভয়ঙ্কর প্রতারক সাকিয়ার জালে পুলিশ

sylhetnewspaper.com
প্রকাশিত জুলাই ২, ২০২১
সিলেটের ভয়ঙ্কর প্রতারক সাকিয়ার জালে পুলিশ

পুলিশের জালে বরাবরই অপরাধীদের ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায়। কিন্তু এবার খোঁদ পুলিশই ধরা পড়েছেন এক ভয়ঙ্কর প্রতারক নারীর জালে। দক্ষিণ সুরমার সিলাম এলাকার কাজের বুয়া সাকিয়া বেগম (৩০) প্রেমের ফাঁদে ফেলে একের পর এক যুবককে করছেন ধরাশায়ী। সাকিয়ার সর্বশেষ শিকার সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশে (এসএমপি) কর্মরত এক পুলিশ কনস্টেবল।

গত ৭ এপ্রিল ওই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে এসএমপি কমিশনার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সাকিয়া বেগম।কিন্তু পুলিশী তদন্তে ওই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এবার ওই কনস্টেবলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা (নম্বর-৩১) দায়ের করেছেন সাকিয়া বেগম। তবে এবারই প্রথম নয়, বছর দেড়েক আগেও আরেক যুবকের বিরুদ্ধে ‘বিয়ের প্রলোভনে’ ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিলেন সাকিয়া।

এ ঘটনায় মামলাও হয়, কিন্তু আদালতে প্রমাণ হয়নি ধর্ষণের ঘটনা। তবে, সাকিয়ার এবারের অভিযোগের সূত্র জুড়ে আছে তার আগের ঘটনার সাথেও। সাকিয়া খাতুন নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার মৃত সিকান্দর আলীর মেয়ে। বর্তমানে তিনি দক্ষিণ সুরমার সিলাম ডালিপাড়ায় বসবাস করেন।

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাকিয়ার নাম আগে ছিলো সাফিয়া খাতুন। ২০০৯ সালে অষ্টাদশী সাফিয়া তার খালাতো ভাই নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার খিদিরপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে শওকত আলীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শওকত-সাফিয়া দম্পতির ঘরে জন্ম নেয়ে শিশু জান্নাত। ১২ বছর আগে সাফিয়ার বাবার মৃত্যুর পর তার মা আলেখা বেগম সন্তানদের নিয়ে চলে আসেন সিলেটে।

বসবাস শুরু করেন দক্ষিণ সুরমার সিলাম ডালিপাড়া এলাকায়। স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় শিশু জান্নাতকে নিয়ে সাফিয়াও চলে আসেন সেখানে। নাম বদলে সাফিয়া থেকে হয়ে যান সাকিয়া খাতুন। পরবর্তীতে বিভিন্ন বাসা ও ব্যাচেলর মেসে রান্নাবান্নার কাজ জুটিয়ে নেন সাকিয়া। ২০১৬ সালে নিজেই তালাক দেন স্বামী শওকত আলীকে। প্রায় সময় সাকিয়া দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুলস্থ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে নিজস্ব একাউন্টে টাকা জমা এবং উত্তোলন করতে আসতেন।

সেই সূত্রে ব্যাংকের অফিস সহকারী ইকবাল হোসেনের সাথে পরিচয় এবং একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে সাকিয়ার। ইকবাল হোসেন ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলার পাগলীকুল গ্রামের মৃত আবুল বাসারের ছেলে। চাকরীর সুবাদে তিনি নগরীর তালতলা এলাকায় বসবাস করতেন, ইকবাল নিজেও বিবাহিত ছিলেন। ২০১৯ সালের শুরুতে প্রেমের সূচনা হলেও, বছর শেষ হতে হতে সাকিয়া-ইকবালের প্রেমও ফুরিয়ে আসে। একসময় নিজেকে গর্ভবতী দাবি করে ইকবালকে বিয়ের জন্য চাঁপ দেন সাকিয়া।

ইকবাল বিয়ে করতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিভিন্নভাবে ইকবালের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করতে থাকেন, ওই টাকা না দিলে মিথ্যা মামলায় জড়ানোরও হুমকি দেন। একাধিক ব্যক্তি সাকিয়ার হয়ে ইকবালের কাছে লাখ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ওই বছরের ২৩ নভেম্বর সাকিয়ার বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় অভিযোগ (নম্বর-১২১০) দায়ের করেন ইকবাল হোসেন। ওই সময় স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা সাকিয়া ও ইকবালকে নিয়ে শালিসে বসেন। সেখানে সাকিয়া ৫ লাখ টাকা দাবি করেন ইকবালের কাছে। ইকবাল ওই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ‘জোরপূর্বক পালাক্রমে’ ধর্ষণের অভিযোগ এনে একটি মিথ্যা মামলা (নারী ও শিশু মামলা নং-১/২০) দায়ের করেন সাকিয়া খাতুন।

তদন্তকালে মেডিকেল রিপোর্ট ও অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করার পর ধর্ষণের আলামত না পাওয়ায় মামলাটি খারিজ করে দেন বিচারক। একই সাথে সাকিয়ার গর্ভবতী হওয়ার বিষয়টিও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে মেডিকেল রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি দাখিল করেন সাকিয়া।

ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা হওয়ায় ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সেই নারাজিও খারিজ করে দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রইব্যুনালের বিচারক (সিনিয়র জেলা জজ) মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এদিকে, ভয়ে ও লজ্জায় একদিন রাতের অন্ধকারে সিলেট ছেড়ে পালিয়ে যান ইকবাল হোসেন।২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর দক্ষিণ সুরমা থানার ওয়ারলেস অপারেটর কনস্টেবল রাসেলের মুঠোফোনে একটি কল আসে। রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে সাকিয়ার গলা ভেসে আসে। তিনি রাসেলের কাছে ইকবালের দায়েরকৃত অভিযোগের কপি চান। এ সময় রাসেল তাকে থানার মুন্সির সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর মাঝেমধ্যেই রাসেলকে ফোন দিতেন সাকিয়া। একপর্যায়ে রাসেলকেও জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করেন তিনি। বারবার তাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করা নৈমত্যিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছিলো। রাসেলের কাছেও একাধিকবার নগদ অর্থ চাঁদা দাবি করেন সাকিয়া ও তার সহযোগীরা।

চলতি বছরের ৭ এপ্রিল এসএমপি কমিশনার নিশারুল আরিফের বরাবরে কনস্টেবল রাসেলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সাকিয়া খাতুন। অভিযোগে সাকিয়া ধর্ষণের কথা উল্লেখ করেন একইভাবে, ঠিক যেভাবে দেড়বছর আগে পিওন ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা দায়ের করেছিলেন। অভিযোগের তদন্তভার পড়ে এসএমপি’র সহকারী কমিশনার (ফোর্স) মো. সামসুদ্দিন ভূঁইয়ার কাঁধে। এদিকে, সাকিয়ার সহযোগীরা বিষয়টি সমাধান করে দেওয়ার কথা বলে বিভিন্নভাবে কনস্টেবল রাসেলের কাছে লক্ষাধিক টাকা চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু তাদের এসব প্রস্তাবে রাজি হননি রাসেল।

দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড সদস্য মো. জাবেদ আহমদ জীবন জানান, দু বছর ধরে সাকিয়া বেগম তার পরিবার ছেড়ে একা আলাদা বাসা নিয়ে বসবাস করছেন। এর আগেও তিনি স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত ইকবাল হোসেন নামক এক ছেলের সাথে পরকিয়ায় জড়িয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। ছেলেটি এতে রাজি না হওয়ায় সিলেট আদালতে মামলা দায়ের করেন সাকিয়া। এর আগে স্থানীয় লোকজন বিষয়টি মিমাংসার চেষ্টা করলে সালিশে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন এবং নিজেকে গর্ভবতী বলেও দাবি করেন। সে সময় ৫ লাখ টাকা দিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন ইকবাল। ইউপি সদস্য আরো জানান, মহিলাটি খারাপ চরিত্রের। তার ছোটবোনও তালাকপ্রাপ্ত হয়ে মায়ের সাথে থাকে। তার বড়ভাই এরশাদ একটি মেয়েকে বিয়ে করে তালাক দিয়েছে।

সাকিয়ার মা আলেখা বেগম জানান, সাকিয়া রাগ করে তাদের বাসা থেকে চলে যায় এবং সিলাম ডালিপাড়ায় আব্দুল আজিজের বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস শুরু করে। একাধিকবার অনুরোধ করা স্বত্বেও সাকিয়া পরিবারের সাথে থাকতে অস্বীকৃতি জানান এবং একা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে ব্যাংকের পিওনর ইকবালের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা এবং বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কথায স্বীকার করেন আলেখা বেগম। তিনি আরো জানান, তার মেয়ে কারো কথা শুনে না, নিজের ইচ্ছেমতো চলাফেরা করে। প্রায় সময় সাকিয়া তার মেয়ে জান্নাতকে তার নানির কাছে রেখে যায় বলেও আলেখা বেগম তার বক্তব্যে জানান।

গত ৯ মে পুলিশ কমিশনার বরাবরে ৬১ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন সহকারী কমিশনার সামসুদ্দিন। পুলিশী তদন্তে সাকিয়ার এ অভিযোগও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। বর্তমানে কনস্টেবল রাসেল আহমদ এসএমপি পুলিশ লাইন্সে নজরদারিতে রয়েছেন।তবে অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও, থেমে নেই সাকিয়া। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় এবং চাঁদার টাকা না পেয়ে বুধবার কনস্টেবল রাসেলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা থানায় মামলা দায়ের করেছেন সাকিয়া।

এ ব্যাপারে কনস্টেবল রাসেল জানান, এই মহিলার সাথে আমার কোনো ধরণের সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। সে এর আগেও ব্যাংকের এক কর্মচারীকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে। আদলতে তার ধর্ষণের অভিযোগটি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। এবার সে আমার পেছনে পড়েছে। আমার বিরুদ্ধে কমিশনার স্যারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে। সেই অভিযোগও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। মূলত, সাকিয়ার দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দেওয়ায় আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছে সে। আমি পুলিশ সদস্য হয়েও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এখন ওই মহিলা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা দিয়েছে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন