শেখ মোঃ লুৎফুর রহমান::সংবাদিকতা একটি কঠিন ও মহান পেশা। এ পেশাকে মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এ পেশার লোকজনকে অনেকেই জাতির বিবেক বলে থাকেন।
আজকাল দেখা গেছে সাংবাদিকতার এ মহান পেশা ক্রমান্বয়ে কলুষিত হয়ে আসছে-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার নামে এক ধরনের অপসাংবাদিকতার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঠিক যেন ‘চেরাগের নিচে অন্ধকার’।
বাস্তবে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতার সাবলীল মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। শুধু দেশ, জাতি নয়, বিশ্ব উন্নয়ন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা দেশে দেশে স্বীকৃত। সাধারণ জনগণের এ মহান পেশার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে।
কারণ এ সমাজের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরবারির ন্যায় কলমের শানিত অস্ত্র একমাত্র সাংবাদিকরাই ধরে থাকেন। বিভিন্ন ধরনের ঘটনা প্রবাহের সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি পত্রিকার মাধ্যমে দেশের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় বিষয়ও অহরহ দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তাই তো প্রকৃত সাংবাদিকের কোন দেশ কাল পাত্র নেই।
তারা জগৎ সভার এক একজন পরীক্ষক ও নিরীক্ষক। সামাজিক অনাচার ও বৈপরিত্যের বিরুদ্ধে সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, মবানবতার অতন্দ্র প্রহরী সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির শেষ ভরসা। তাদের তৃতীয় নয়ন সব সময় সত্য উদ্ঘাটন ও নিরপক্ষতার চোখ হয়ে ঘটনার গভীরে গিয়ে বাস্তবসত্য উন্মোচনে পারঙ্গম হবে, এটাই পাঠক ও দর্শক সমাজ আশা করেন।
সৎ ও নিষ্ঠাবান সাংবাদিকরা বিদ্যমান শত চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করেই তাদের পেশার সম্মানকে অমলিন রেখেছেন। এ পেশা মূলতঃ শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। তাই এই মহান পেশার সেবকদের ওপর যখন জুলুম ও নির্যাতন নেমে আসে তখন আমরা ব্যথিত হই। তবে আমরা এর চাইতে বেশি ব্যথিত ও মর্মাহত হই তখনই, যখন দেখি কোন সাংবাদিক ভাই ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, অহংকার কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধ বিসর্জন দিয়ে বা পেশাগত নীতি, নৈতিকতা জলাঞ্জলী দিয়ে বিভিন্ন স্খলনের শিকার হন !
সাংবাদিকতা যতোটা না পেশা তার চেয়ে অনেক বেশি নেশা, ভালোলাগা। এই নেশাটা হচ্ছে দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার নেশা। আমার মনে হয়, একজন চিকিৎসক যেভাবে মানুষের সেবা করতে পারেন তার চেয়ে অনেক বেশি সেবা করতে পারেন একজন সাংবাদিক। কোন সাংবাদিকের এই নেশা কেটে গেলে তিনি তখন যতোটা না সাংবাদিক থাকেন তার চেয়ে বেশি চাকুরিজীবী!
এদিকে এই মহান পেশা ক্রমান্বয়ে কলুষিত হয়ে আসছে-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের স্বাধীনতার নামে এক ধরনের অপসাংবাদিকতার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঠিক যেন ‘চেরাগের নিচে অন্ধকার’। বিভিন্ন লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মী, অর্থলোভী, স্বার্থান্বেষী, টাউট-বাটপার, প্রতারক, নেশাখোর,চাঁদাবাজ, তথ্য গোপনকারী, বদমায়েশ টাইপের লোক, নারীলোভী, মাদক পাচারকারী, ঠগ, ধান্ধাবাজ, সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিরা এখন সাংবাদিকতার কার্ড ঝুলিয়ে যথেষ্ট বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে এ মননশীল কর্মচর্চায়। তারা জেনে শুনেই ব্যাখ্যার স্থলে অপব্যাখ্যা, ন্যায়কে অন্যায়ের রূপ দান, সত্যকে ঢাকার জন্য অসত্যের আবরণ দেওয়াকে মনে করেন সাংবাদিকতার বিজ্ঞতা!
অনেকক্ষেত্রেই চোখে পড়ে, সংবাদ লেখার যোগ্যতা নেই অথচ সাংবাদিক। সম্পাদনা করার মেধা নেই অথচ সম্পাদক। দু’লাইন / দু’কলম শুদ্ধ বাংলা বলতে ও লিখতে পারেনা অথচ তারা রিপোর্টার! যে জানেনা কোনটা সংবাদ, কোনটা সংবাদ না, বা একটা প্রতিবেদন কিভাবে লিখতে হয় তার কোন জ্ঞান নেই সে হয়ে যায় মস্তবড় প্রতিবেদক, কলামিষ্ট ও লেখক ! এ হচ্ছে সংবাদপত্র জগতের একটি ভয়ংকর চিত্র। এগুলো থেকে অপসাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করেছে চারদিকে। আর এই অপসাংবাদিকতার বিকৃত আরেকটি প্রচলিত শব্দ হচ্ছে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’।
‘হলুদ সাংবাদিকতা’ কোন সাংবাদিকতা নয়, সেটাকে কোনভাবেই সাংবাদিকতার আবরনে রুপ লাভ দেওয়াও যায় না। তাই হলুদ সাংবাদিকতা একটি বিকৃত ও অপ-সাংবাদিকতার নেতিবাচক দিক মাত্র। হলুদ সাংবাদিকতার জন্য দায়ী মূলতঃ এক শ্রেণীর সাংবাদিক ও সংবাদপত্র এবং কিছু ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার মালিক ও সম্পাদকবৃন্দ। এর সাথেই রয়েছে দেশ ও সমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের বাস্তব চিত্র । এদের কারণেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাংবাদিক মাত্রই সাধারণ মানুষের কাছে পরিণত হয়েছে এক ভীতিকর প্রাণীতে। মানুষ সাংবাদিক দেখলেই ‘সাংঘাতিক’ বলে আঁৎকে উঠে।
কারণ হচ্ছে লেখার স্বাধীনতার সুবাদে এরা ন্যূনতম বিধি-বিধান আর নীতি-জ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে ‘রাতকে দিন’ আর ‘দিনকে রাত করে’ সংবাদ পরিবেশন করেন। বিবেকের কাছে প্রশ্ন জাগে এটি আবার কেমন সাংবাদিকতা? সত্যকে গোপন করে মিথ্যাকে ফুলিয়ে রং লাগিয়ে প্রচার করাটা সাংবাদিকতার কোন স্তরে পড়ে ? সংবাদ পরিবেশনায় এক চোখা/বায়াসড আর তিলকে তাল বানানোর উদ্ধতা, অবশ্যই সচেতন পাঠক সমাজ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবে এটা স্বাভাবিক ।
মানুষ শত শত ভালো উদাহরণ, ভালো কাজ আর মানসম্পন্ন সংবাদকে মনে করে না এবং মনে রাখেও না। নাগরিকদের কাছে এর চাইতেও আজকাল অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভাইরাল বিতর্কে অংশগ্রহণ, কিংবা আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর রাখার কাজ।
আর এভাবেই সাধারণ নাগরিকদের মাধ্যমেই হেরে যায় হেরে যায় সাংবাদিকতা, জিতে যায় অপ-সাংবাদিকতা, হলুদ সাংবাদিকতা। সাধারণ জনগণের এই উদাসীনতাই আজ বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া হাউজগুলোর আর্থিক ও নৈতিক দুরবস্থার কারণ হয়তো। একদিকে রাষ্ট্রের কাছে রীতিমতো নিগৃহীত(ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও রাজনীতিকদের বৈরিতার শিকার), সেই সাথে সাধারণ মানুষের আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা, উদাসীনতা সাংবাদিকদের জীবনকে করেছে নিরাপত্তাহীন আর সাংবাদিকতায় তোষামোদি সংস্করণ বেড়েছে।
হয়তো ভাইরাল বিষয়বস্তুতে বিতার্কিক না হয়ে, একজন সংবাদ পাঠক এবং সচেতন নাগরিক হলে বরং দেশের সাংবাদিকতার এই হাল হতো না, সাংবাদিকদের জীবন নিরাপত্তা নিয়ে এই ছেলেখেলাও দেখতে হতো না।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন